ভারতীয় রেলের ইতিহাস অতি দীর্ঘ ও বৈচিত্র্যময়। এই দীর্ঘ পথ চলার মধ্যে এমন কিছু ট্রেন রয়েছে, যেগুলির সঙ্গে শুধু যাত্রী পরিবহণের সম্পর্ক নয়, রয়েছে স্থানীয় আবেগও। এমনই একটি ট্রেন রয়েছে, যেটি ৭৫ বছর ধরে বিনা ভাড়ায় চলাচল করছে এবং এই ট্রেনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একটি ঐতিহাসিক কাহিনি। এই বিশেষ ট্রেনটি চলাচল করে হিমাচলপ্রদেশ এবং পঞ্জাবের ভাখড়া এবং নঙ্গল রেলপথে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রেল পরিবহন ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত, তবে ভারতের কিছু ট্রেন অতীতের স্মৃতি এবং আবেগের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ভাখড়া-নঙ্গল রেলপথে চলা ট্রেন, যা স্থানীয় মানুষের কাছে এক বিশেষ অনুভূতির জায়গা। এটি একমাত্র ট্রেন যা ৭৫ বছর ধরে বিনা ভাড়ায় যাত্রীদের পরিষেবা দিয়ে আসছে।
এই ট্রেনটি কোথায় চলে?
এটি হিমাচলপ্রদেশ এবং পঞ্জাবের ভাখড়া এবং নঙ্গল জলাধারের মধ্যে চলে। এই ট্রেনে চড়লে একদিকে যেমন দেখা যায় শিবালিক পর্বতমালা, অন্যদিকে চলতে থাকে শতদ্রু নদী। প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ট্রেনটি আপনাকে নিয়ে চলে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে। শুরু থেকেই এই ট্রেনটি একদিনের জন্যও থেমে যায়নি। এর দীর্ঘ যাত্রার ইতিহাস এবং গ্রামের সঙ্গে এর সম্পর্ক অনেকটাই গভীর।
এই ট্রেনের ইতিহাস কী?
১৯৪৮ সালে যখন হিমাচলপ্রদেশ এবং পঞ্জাবে ভাখড়া এবং নঙ্গল জলাধারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়, তখন এই জলাধারগুলির জন্য ভারী যন্ত্রপাতি ও শ্রমিকদের পরিবহণের প্রয়োজন ছিল। পার্বত্য অঞ্চলে এই সব সামগ্রী পরিবহণ করা খুবই কঠিন ছিল। সেই কারণেই এই রেলপথটি তৈরি করা হয়েছিল। মূলত জলাধারের নির্মাণ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি পরিবহণ করতে এবং শ্রমিকদের আনা-নেওয়ার জন্য এই ট্রেনটির সূচনা হয়েছিল।
এখন ৭৫ বছর পরেও এই ট্রেনটি চালু রয়েছে। এর ১৩ কিলোমিটার রেলপথের যাত্রা শুরু হয় পঞ্জাবের রূপনগর জেলার নঙ্গল স্টেশন থেকে এবং একাধিক গ্রামের মধ্যে দিয়ে চলে হিমাচলপ্রদেশের বিলাসপুর জেলার ভাখড়া স্টেশনে। প্রতিদিন প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ গ্রামবাসী এবং স্কুলপড়ুয়া এই ট্রেনে চড়ে তাদের গন্তব্যে পৌঁছান। এই ট্রেনের কামরাগুলি কাঠের তৈরি এবং ডিজেল ইঞ্জিন দিয়ে চলে। পুরো দিন জুড়ে একটি ট্রেন চলে, যা বিকেলে ফিরে আসে।
ট্রেনটি কেন বিনা ভাড়ায় চলে?
ভাখড়া-নঙ্গল রেলপথের এই ট্রেনটি কেন বিনা ভাড়ায় চলে, তার একটি বিশেষ কারণ রয়েছে। এটি শুধু একটি ট্রেন নয়, এটি গ্রামবাসীদের আবেগের অংশ। ৭৫ বছরের বেশি সময় ধরে এই ট্রেনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বহু পরিবারের ইতিহাস। একাধিক প্রজন্ম ধরে একসঙ্গে এই ট্রেনে যাতায়াত করা হয়েছে। এটি শুধু একটি যাতায়াতের মাধ্যম নয়, বরং একটি ঐতিহ্য, একটি স্মৃতি। এই ট্রেনের প্রতি ভালোবাসা এবং স্থানীয় মানুষের আবেগের কারণে ভাড়া নেওয়া হয় না।
তাছাড়া, এই ট্রেনের যাত্রীরা প্রায়ই বলেন, ট্রেনের জানালা দিয়ে আশপাশের সৌন্দর্য দেখতে খুবই ভালো লাগে। কিছু স্কুলপড়ুয়া জানান, যদি ট্রেনটি ধরতে না পারেন, তাহলে অনেক দূরে হেঁটে স্কুলে যেতে হয়। এটি স্থানীয়দের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পর্যটকরা কি এই ট্রেনে চড়তে পারেন?
হ্যাঁ, পর্যটকরা চাইলে এই বিশেষ ট্রেনে চড়তে পারেন। ভাখড়া এবং নঙ্গল জলাধারের সৌন্দর্য উপভোগ করতে একদিনের সফর করা যায়। পঞ্জাব থেকে আপনি সকাল ৭টা ৫ মিনিটে নঙ্গল স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে ভাখড়া জলাধার দেখতে যেতে পারেন এবং বিকেলে ফিরতি ট্রেনে ফিরে আসতে পারেন। ভাখড়া জলাধারও পর্যটকদের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য, যেখানে আপনি প্রকৃতির অপরূপ রূপ উপভোগ করতে পারবেন।
এছাড়া, ট্রেনটির পথে শিবালিক পর্বত এবং শতদ্রু নদীর সৌন্দর্যও আপনাকে মুগ্ধ করবে। ভারতের এই বিশেষ ট্রেনটি একটি অমূল্য রত্ন, যা শুধু যাত্রীদের পরিবহণ করে না, বরং স্থানীয় মানুষের আবেগ এবং ঐতিহ্যও ধারণ করে।
ভারতের এই ভাখড়া-নঙ্গল রেলপথের ট্রেনটি শুধু একটি যাতায়াতের মাধ্যম নয়, বরং স্থানীয় জনগণের আবেগ এবং ঐতিহ্যের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৭৫ বছর ধরে এই ট্রেনটি যে প্রভাব ফেলেছে, তা শুধু একটি পরিবহণ ব্যবস্থা নয়, বরং এক টুকরো ইতিহাস, যা গ্রামবাসীদের জীবনে এক অপরিহার্য জায়গা তৈরি করেছে।
আপনি যদি প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং ইতিহাসের এক অনন্য অংশ অনুভব করতে চান, তাহলে একবার হলেও এই ট্রেনে চেপে ভাখড়া এবং নঙ্গল জলাধারের অসাধারণ দৃশ্য দেখতে ভুলবেন না।

