Tuesday, May 13, 2025

প্রভাত রায়: এক পরিচালক, এক গুরু, এক অনুপ্রেরণা

Share

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক প্রভাত রায়ের ৮১তম জন্মদিন! ভাবতেই অবাক লাগে। একটা সময় ছিল, যখন আমরা একসঙ্গে একের পর এক সফল ছবি উপহার দিয়েছি বাংলা সিনেমাকে। ‘পাপী’, ‘প্রতীক’, ‘প্রতিকার’, ‘সেদিন চৈত্রমাস’— একাধিক সিনেমায় আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি, এবং প্রতিটিই দর্শকের মন জয় করেছিল। শুটিংয়ের ফাঁকে কত আড্ডা হত! কত গল্প শুনেছি দাদার মুখ থেকে! আজ, এই বিশেষ দিনে, তাঁর সঙ্গে কাটানো কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত ভাগ করে নিতে চাই।

উত্তমকুমার ও উৎপল দত্তের সেই বিখ্যাত দৃশ্য

প্রভাতদা ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে পরিচালক শক্তি সামন্তের সহকারী ছিলেন। পরে ‘আনন্দ আশ্রম’-এর সাফল্যের পর তিনি ‘অমানুষ’ ছবিটি পরিচালনা করেন, যেখানে উত্তমকুমার ও উৎপল দত্ত একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। উত্তমদা, যদিও মহানায়ক, কিন্তু খুব বেশি অ্যাকশন দৃশ্যে অভিনয় করতেন না। তাই যখনই অ্যাকশন দৃশ্যের কথা উঠত, তিনি বেশ গম্ভীর হয়ে যেতেন। তিনি দৃশ্যকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য প্রচণ্ড সিরিয়াস হয়ে যেতেন।

একটি দৃশ্যে উত্তমকুমারকে উৎপল দত্তকে ঘুষি মারতে হত। উত্তমদা বাস্তবে কুস্তি শিখেছিলেন, ফলে গায়ে ছিল অসম্ভব জোর। তিনি এতটাই শক্ত ঘুষি মেরেছিলেন যে উৎপলবাবু মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন! শুটিংয়ের মাঝে এমন দুর্ঘটনা সবাইকে হতবাক করে দিয়েছিল। তখন প্রভাতদা উত্তমদাকে বুঝিয়েছিলেন, “অ্যাকশন দৃশ্যে সত্যি সত্যি মারতে হয় না!” উত্তমদা ব্যাপারটি উপলব্ধি করে নিজেও অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলেন। এরপর থেকে উৎপল দত্ত উত্তমকুমারকে দেখলেই একটু দূরে সরে দাঁড়াতেন, মজা করে বলতেন, “আর মারবেন না! অত জোরে মারবেন না!” আমরা সবাই মিলে সে দিন হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়েছিলাম!

অ্যাকশন দৃশ্যে প্রভাতদার পারদর্শিতা

প্রভাতদা অ্যাকশন দৃশ্য বোঝার ক্ষেত্রে ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁর ছবিতে মারপিটের দৃশ্যগুলোর আলাদা একটা আবেদন থাকত। তাঁর শুটিং স্টাইল এতটাই সাবলীল ছিল যে, আমি নিজেও বিশেষ কিছু অ্যাকশন দৃশ্য শুট করার সময় দারুণ তৃপ্তি পেতাম। বাংলা সিনেমায় তিনি এমন একটি ঘরানা তৈরি করেছিলেন, যা তাঁর পরে রাজ চক্রবর্তীর মতো পরিচালকের মাধ্যমে এগিয়ে চলেছে। আমার পর প্রভাতদা ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করেছেন এবং তাঁদের দিয়েও দুর্দান্ত অ্যাকশন দৃশ্য করিয়েছেন।

অমিতাভ বচ্চন ও প্রভাত রায়ের কৌশল

আরেকটা মজার ঘটনা বলি। অমিতাভ বচ্চন ‘অনুসন্ধান’ ছবিতে অভিনয় করছেন। বাংলায় কথা বলা তাঁর পক্ষে কঠিন ছিল, অথচ ছবিটি বাংলায় ডাব করা হবে। তখন প্রভাতদা একটি কৌশল বের করলেন। দূরের শটে অমিতাভ ইংরেজিতে ‘১ থেকে ৬’ পর্যন্ত গুনতেন! এতে তাঁর মুখের নড়াচড়া ঠিক থাকত, কিন্তু দর্শক বুঝতেই পারত না তিনি কী বলছেন! পরে ভয়েস আর্টিস্ট সেটি ডাব করতেন। ক্লোজ-আপ শটের জন্য তাঁকে বাংলা বলতেই হত। এই চতুরতার জন্যই প্রভাতদা ছিলেন অনন্য।

একটা কঠিন সময় ও একতা ভট্টাচার্য

প্রভাতদার জীবন সবসময় সহজ ছিল না। স্ত্রী জয়শ্রী রায় মারা যাওয়ার পর তিনি ভীষণ একা হয়ে পড়েছিলেন। চারপাশে কেউ ছিল না, অসুস্থতাও পিছু নিয়েছিল। ঠিক তখনই ঈশ্বরের দূত হয়ে এলেন একতা ভট্টাচার্য। তিনি নিঃস্বার্থভাবে প্রভাতদার পাশে দাঁড়ালেন, তাঁকে আগলে রাখলেন, চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। এমনকি তাঁকে দিয়ে আত্মজীবনী ‘ক্ল্যাপস্টিক’ লিখিয়ে নিলেন! আজকের দিনে এত নিঃস্বার্থভাবে ক’জন এমনটা করে? একতার প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা।

প্রভাতদার উত্তরাধিকার

প্রভাত রায় শুধু একজন সফল পরিচালক নন, তিনি ছিলেন বহু অভিনেতা-অভিনেত্রীর গুরুও। তাঁর হাত ধরে চলচ্চিত্র জগতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, টোটা রায়চৌধুরী, সঞ্জীব দাশগুপ্তের মতো শিল্পীরা। তিনিই আমার প্রথম ছবি ‘মর্যাদা’র ক্ল্যাপস্টিক দিয়েছিলেন।

অনেকে জানতে চান, আমার পরে ভিক্টর ও বুম্বাদাকে নিয়ে প্রভাতদা কাজ করেছেন, এতে কি আমি হীনম্মন্যতায় ভুগেছি? না, কখনোই না। প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কখনোই দেখিনি ওঁদের। বরং মনে করেছি, চরিত্রের উপযুক্ত বলেই প্রভাতদা তাঁদের নির্বাচন করেছেন।

আজ, প্রভাত রায়ের জন্মদিনে, তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলতে চাই— বাংলা চলচ্চিত্রে আপনার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

ভারতের উপর পাল্টা শুল্ক চাপাচ্ছেন ট্রাম্প! ঘোষণা করলেন নির্দিষ্ট তারিখও

Read more

Local News