Sunday, April 13, 2025

আগাম প্রস্তুতির জেরে ওড়িশায় রক্ষা পেল অসংখ্য প্রাণ, ঘূর্ণিঝড় ‘ডেনা’ ও ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব কম রাখল

Share

ঘূর্ণিঝড় ‘ডেনা’ ও ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব কম

ঘূর্ণিঝড়ের মুখোমুখি হওয়া নতুন কিছু নয় ওড়িশার জন্য। এই রাজ্যের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে অক্টোবর মাসে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের সম্মুখীন হয়ে আসছেন। এতবছরের দুর্যোগ মোকাবিলার অভিজ্ঞতা থেকেই এবারও ঘূর্ণিঝড় ‘ডেনা ’র সাথে লড়াইয়ে প্রাণহানি রোধে বিশেষ কৌশল এবং পরিকল্পনা নেয় প্রশাসন, যা শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে।

বুধবার রাতে ঘণ্টায় ১১০-১২০ কিলোমিটার গতিবেগে ওড়িশার উপকূলে আছড়ে পড়ে ‘ডেনা’। ঝড়ের তাণ্ডব শুক্রবার সকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। মুখ্যমন্ত্রী মোহনতরণ মাঝি শুক্রবার সকালে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে ঘোষণা করেন যে, এই দুর্যোগে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। তবে ক্ষতির হিসাব পুরোপুরি পাওয়া যায়নি।

সাফল্যের পেছনে সচেতন প্রস্তুতি এবং সঠিক পরিকল্পনা

ওড়িশা সরকারের আগে থেকেই প্রস্তুতি থাকায় এবারের ঝড় মোকাবিলা ছিল তুলনামূলক সহজ। বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণাবর্তের সঙ্কেত পাওয়ার পর থেকেই রাজ্যের জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, দমকল, পুলিশ, এবং জেলা প্রশাসন তৎপর হয়। সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি কমাতে, উপকূলীয় এলাকায় পাঁচ দিন আগেই উদ্ধারকারী দল মোতায়েন করা হয়। ঝড় আঘাত হানার আগেই বিভিন্ন দুর্যোগপ্রবণ এলাকা থেকে মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়, যা প্রাণহানি রুখতে বড় ভূমিকা রেখেছে।

দুর্যোগপ্রবণ জেলাগুলির বিশেষ তদারকি

ওড়িশা সরকার ঘূর্ণিঝড়-প্রবণ ১০টি জেলা চিহ্নিত করে সেখানে আগেভাগেই জরুরি পরিস্থিতি সামলানোর জন্য ২০টি জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর দল এবং ৫১টি রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর দল মোতায়েন করেছিল। বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসাবে ভদ্রক, কেন্দ্রাপাড়া, জগৎসিংহপুর, পুরী, বালেশ্বর, এবং ময়ূরভঞ্জকে মনিটরিংয়ের জন্য অভিজ্ঞ আমলাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

ডেনা

ঝড়ের প্রধান আঘাত হানে কেন্দ্রাপাড়া ও ভদ্রক অঞ্চলে। এই এলাকায় বুধবার রাতেই ‘ডেনা’র ল্যান্ডফল ঘটে। আগেই এই এলাকার মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, যা প্রাণহানি রোধে সহায়ক হয়। ওড়িশার উপকূলীয় এলাকাগুলি থেকে প্রায় ৬ লক্ষ মানুষকে সরিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। রাজ্য প্রশাসন ৮৩২২টি সাইক্লোন সেন্টার প্রস্তুত রেখেছিল, যেখানে বিপদাপন্ন মানুষদের রাত ১০টার মধ্যে আশ্রয় দেওয়া হয়।

ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি হ্রাসের বিশেষ ভূমিকা

ঘূর্ণিঝড়ের গতি এবং আঘাত কম হওয়ার পেছনে ‘ডেনা’র ল্যান্ডফল প্রক্রিয়াও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাধারণত, ল্যান্ডফল ৫-৬ ঘণ্টার মধ্যে সম্পন্ন হলেও, ‘ডেনা’র ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া চলে প্রায় ৮-৯ ঘণ্টা ধরে। ফলে ঝড়ের অভিঘাত অনেকটা দুর্বল হয়ে যায়। এছাড়া সমুদ্রে দুটি বিপরীত ঘূর্ণাবর্তের উপস্থিতি থাকার কারণে ‘ডেনা’ আরও শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনি, যা প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি কম রাখতে সাহায্য করেছে।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং সচেতনতার প্রচেষ্টা

প্রতিবারের দুর্যোগ মোকাবিলায় শিক্ষা নিয়ে এবার আরও কয়েকটি নতুন পদক্ষেপ নেয় ওড়িশা সরকার। ঝোড়ো হাওয়ায় বড় বড় বিলবোর্ড ও হোর্ডিং ভেঙে পড়ে প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে। তাই উপকূলীয় এলাকাগুলি থেকে এই হোর্ডিং এবং বিলবোর্ড খুলে নেওয়া হয়েছিল। এর পাশাপাশি স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে সাধারণ মানুষকে দুর্যোগ সম্পর্কে সতর্ক করতে সচেতনতার প্রচার চালানো হয়। বছরে দুইবার দুর্যোগ মোকাবিলার প্রশিক্ষণ এবং মহড়া দেয় রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী।

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল উপকূলীয় এলাকার প্রায় ১২০০ গ্রামের মানুষকে সাইরেনের মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে সতর্ক করার ব্যবস্থা। এই সাইরেনের মাধ্যমে মানুষকে বিপদের সঙ্কেত পৌঁছে দেওয়া হয়, যাতে তারা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে পারেন।

উপসংহার

ওড়িশার প্রস্তুতি এবং সঠিক সময়ের পদক্ষেপের জন্য এবারের ঘূর্ণিঝড় ‘ডেনা’র আঘাত থেকেও প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে দুর্যোগ মোকাবিলার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে, প্রাক-প্রস্তুতি ও যথাযথ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে প্রশাসন, যা প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। আবহবিদদের মতে, ঘূর্ণিঝড়ের গতি কম হওয়া এবং দুর্বল ল্যান্ডফল প্রক্রিয়া এই সফলতার অন্যতম কারণ।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের সামনে মানুষ অসহায় হলেও, যথাযথ পদক্ষেপ এবং প্রস্তুতি থাকলে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হয়, যার বাস্তব উদাহরণ ওড়িশা।

Read more

Local News