Thursday, December 4, 2025

শত্রুর আকাশে সিঁদ কেটে জেট চুরি: মোসাদের ‘অপারেশন ডায়মন্ড’-এর রূপকথার মতো অভিযান

Share

মোসাদের ‘অপারেশন ডায়মন্ড’-এর রূপকথার মতো অভিযান!

কোনও হলিউড ফিল্মের কল্পকাহিনি মনে হলেও সত্যি ঘটেছিল—শত্রু দেশের আকাশ থেকে লড়াকু জেট চুরি করে এনে নিজের বিমানবাহিনীর কাছে তুলে দেওয়ার এক দুঃসাহসী, নিখুঁত গোয়েন্দা অভিযান। শীতল যুদ্ধের দিনে আরব-বিশ্বের সামরিক স্তর বদলে দেওয়াই ছিল ইহুদিদের উদ্দেশ্য। নাম হয়েছিল— অপারেশন ডায়মন্ড

ঐতিহাসিক কালে ১৯৬০-এর দশকে সোভিয়েত তৈরি মিগ-২১ লড়াকু জেট তখন মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে ঘোরাঘুরি করছিল। ১৯৫৯ থেকে সোভিয়েত বাহিনীতে যোগ দেওয়া মিগ-২১ দ্রুতই বিশ্ববাজারে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় তার সক্ষমতা দেখিয়ে দেয় যে, পশ্চিমা কৌশলবাহিনী সহজে অতিক্রম করতে পারবে না—ফলত দেশগুলো ক্রমে সোভিয়েত থেকে মিগ আমদানি শুরু করে। এর প্রভাব পড়ল ইজরায়েল পর্যন্ত: তাদের মুখোমুখি আরব দেশগুলোর ঝাঁকানি বেড়ে গেল, এবং আকাশসীমায় প্রাধান্যের বিপদ দেখা দিল তেল আবিবের জন্য।

তাই মোসাদ—ইজরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থাকে—নির্ধারণ করা হয় পরাজয় প্রতিহত করার কৌশল: শত্রুর ঘরে ঢুকে সেভেত তৈরি মিগ-২১ চুরি করে আনা। ১৯৬৩ সালে শুরু হওয়া পরিকল্পনার সফল সমাপ্তি আসে ১৯৬৬ সালের ১৬ অগস্টে। অপারেশন চলাকালে মোসাদের গোপনে নানা চেষ্টা ব্যর্থ হয়—মিশরীয় এক প্রথম প্রচেষ্টা ধ্বংস হয় কায়রোর কড়কড়ে নিরাপত্তায়। কিন্তু পরে লক্ষ্য বদলানো হয়; ইরাকের মধ্যেই একটি পাইলটকে—মুনির রেদফার—বশীভূত করার পথ দেখা যায়।

মিশরের অভিযানের মতো শুরুতেই পরাজয় পেরিয়েও মোসাদ থেমে থাকেনি। প্যারিসে ছদ্মনামে এক এজেন্ট পৌঁছান, বাগদাদের পাইলট রেদফারকে টার্গেট করে মন কাড়ার চেষ্টা ত্বরান্বিত হয়। রেদফা—যিনি কুর্দি বংশোদ্ভূত এবং কর্মক্ষেত্রে নানাবিধ অসুবিধার সম্মুখীন ছিলেন—অবশেষে ইহুদিদের রণকৌশলে সাড়া দেন। পরবর্তীতে তার পরিবারের নিরাপত্তা, সুইস ব্যবস্থায় অর্থ ও আশ্বাসের বিনিময়ে রেদফা রাজি হন তাঁর মিগ-২১টি ইজরায়েলে নিয়ে যাবার জন্য। অপারেশনের সূক্ষ্মায়ুজনীয় প্রস্তুতি শুরু হয়, পরিবারের ব্যবস্থাপনা, পালানোর রুট ঠিক করা—সবই নিখুঁতভাবে সংগঠিত করা হয়।

অবশেষে ১৯৬৬ সালের আগস্টে প্রশিক্ষণকালীন একটি ফ্লাইটের সুযোগে রেদফা মিগ-২১টি চেপে পালান। তুরস্ক হয়ে মধ্য-আকাশে তেল ভরণ, জর্ডানের আকাশ অতিক্রম—সেখান থেকে সিরিয়াকে জানিয়ে তিনি নিজেকে সিরিয়ার পাইলট পরিচয় দেন, প্রশিক্ষণ হারিয়ে ফেলার অজুহাতে এয়ারট্রাফিককে বোকা বানিয়ে ইজরায়েলে অবতরণ করতে সক্ষম হন। পুরো অপারেশনটি এক ঘণ্টারও কম সময় নিয়েছিল। ডিভাইসের প্রযুক্তি, লড়াকু জেটের গঠন ও তার দুর্বলতা সম্পর্কে পাওয়া তথ্য পরবর্তীতে আমেরিকান প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীদের সহায়তায় বিশ্লেষণ করা হয়—ফলে ওয়াশিংটনকেও বড় কৌশলগত লাভ হয়।

অপারের এই সাফল্যই একটি বছর পর ১৯৬৭-এর ছ’দিনের যুদ্ধে ইজরায়েলের অপ্রতিরোধ্য আকাশযুদ্ধ সক্ষমতায় রূপ পাল্টাতে সাহায্য করে। মিশরের সিনাই, গাজা; সিরিয়ার গোলান; জর্ডানের ওয়েস্ট ব্যাংক—এসব অঞ্চল দ্রুতই ইজরায়েলের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। মোসাদের এই ‘চুরি’ কাহিনী কেবল একটি গোয়েন্দা অপারেশন ছিল না—এটি তখনকার কূটনৈতিক ও সামরিক ভারসাম্য পাল্টিয়ে দেওয়ার মতো একটি গেম-চেঞ্জার আঘাত ছিল।

অপারেশন ডায়মন্ড আজও গোয়েন্দা ইতিহাসের কীর্তিময় অধ্যায়—দ্রুত সিদ্ধান্ত, জটিল মানবীয় রগচারণ, আর ঝুঁকির পরিমিতি মিলিয়ে গড়া এক অভিযাত্রা, যা শত্রুপ্রদেশের আকাশকেই পড়ে দেয় অন্য এক নিয়ন্ত্রণের অধীনে।

Read more

Local News