🌿 অনিশ্চয়তার পথেই মুক্তির খোঁজ: কী ভাবে শখের ক্যামেরা কথক হয়ে উঠল অপরূপার জীবনের পেশা

অনিশ্চয়তার পথেই মুক্তির খোঁজ

জলের দুনিয়া, জঙ্গলের সঙ্গ, আর অগণিত অজানা প্রাণীর টান— এই তিনের মিলনেই তৈরি হয়েছে নদিয়ার মেয়ে অপরূপা দে-র আজকের যাত্রাপথ। যে পথের শুরু ছিল একেবারেই অনিশ্চিত। পূর্বস্থলীর চর জঙ্গলে পাঁচ ঘণ্টা ধরে পাখি দেখার অপেক্ষায় বসে থাকা নবীন এক ফোটোগ্রাফারের মনেও তখন কোনও নিশ্চয়তা ছিল না।
অবশেষে যখন মন খারাপ নিয়ে ফেরার কথা ভাবছেন, ঠিক তখনই এক বিস্ময় সামনে এসে দাঁড়াল— শান্ত জলে সাঁতার কাটছে একটি গোসাপ, আর তাকে ঘিরে নীলাভ-সবুজ ফড়িংয়ের সারাবেলা নাচ। শাটার টিপতেই থমকে গেল সেই মুহূর্ত।
এই এক ছবিই রাতারাতি বদলে দিল তাঁর ভবিষ্যৎ— বিশ্বদরবার চিনে ফেলল নদিয়ার অপরূপা দে-কে।

“নিশ্চয়তার আশায় বাঁচি না”— বলেন অপরূপা

অপরূপার কথায়, প্রকৃতির ছবি তুলতে গেলে আগেভাগেই ধরে নেওয়া যায় না যে কোন ফ্রেমে কী পাওয়া যাবে। নতুনের খোঁজই তাঁকে চালিত করে। কখনও ক্লান্তি, কখনও বাধা— কিন্তু লেন্স হাতে থাকলে থামতে ইচ্ছা করে না। তার জন্যই প্রতিটি সফর নতুন যুদ্ধ, নতুন শিক্ষালাভ।

শৈশবেই তৈরি হয়েছিল বন্যপ্রাণ প্রীতির বীজ

নদিয়ার সীমান্তবর্তী গ্রাম তেহট্টে বড় হওয়া অপরূপার শৈশব কেটেছে সবুজের মধ্যে। মা-ই প্রথম তাঁকে রঙিন পাখিগুলো চিনিয়েছিলেন। সেখান থেকেই জন্ম ভালোবাসার। পড়াশোনা করেছেন পদার্থবিদ্যায়, কিন্তু শখের ছবি তোলা ধীরে ধীরে দখল করে নেয় তাঁর মনের বড় অংশ। বাবা একটি ডিএসএলআর কিনে দিলে সেই শখই হয়ে ওঠে সঙ্গী।

প্রথাগত শিক্ষা নেই, তবু লেন্সই তাঁর শিক্ষক

অপরূপা জানান, ফোটোগ্রাফিতে তিনি কোনও পেশাদার প্রশিক্ষণ নেননি। নিজের চেষ্টায় বই পড়ে, ইন্টারনেট ঘেঁটে, এবং অনুশীলন করে শিখেছেন। তাঁর মতে, শিল্পবোধের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত দখল খুব জরুরি— আলো, অ্যাঙ্গেল, ফোকাল লেংথ, ফ্রেমিং— সবই রপ্ত করতে হয় বাস্তব কাজে নেমেই।

পেশা হিসেবে ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফি— কতটা সম্ভাবনা?

এক সময় মানুষ ভাবতেন, ছবি তোলা দিয়ে জীবিকা সম্ভব নয়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, ক্যামেরা কোম্পানি, বন দফতর— নানা জায়গায় সুযোগ তৈরি হয়েছে। বেশিরভাগ কাজই চুক্তিভিত্তিক, কিন্তু তাতেই স্বাধীনতা বেশি।

অপরূপার পেশাগত উড়ান

সমাজমাধ্যমেই এক আন্তর্জাতিক সংস্থার চোখে পড়ে তাঁর তোলা ছবিগুলি। সেখান থেকেই শুরু হয় পেশাদার যাত্রা— ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসাবে কাজ, আন্তর্জাতিক প্রকল্পে অংশগ্রহণ, বিরল প্রাণীর ছবি প্রকাশ— সবই যোগ হতে থাকে তাঁর সাফল্যের খাতায়।

লড়াইয়ের ভিতরে থেকেও এগিয়ে চলা

শুরুতে প্রতিবেশীদের কটাক্ষ— “ফোটোগ্রাফি করে কী হবে?”— শুনতে শুনতেই বড় হয়েছেন তিনি। কিন্তু তাঁর ছবি তাঁদের মনই বদলে দেয়।
বেআইনি প্রাণী পাচার রোধে সচেতনতা তৈরিতে তাঁর কাজ এখন শিক্ষণীয়।
মেয়ে হয়েও রাতের পর রাত জঙ্গলে থাকা— বিপদ, টেনশন, ভয়— সবই ছিল। মা–বাবা আজও চিন্তায় থাকেন, তবু অপরূপার সাহস তাঁদেরও শক্তি জোগায়।

লাদাখ থেকে সুন্দরবন— অনন্ত বিস্ময়ের খোঁজে

তিব্বতি নেকড়ে, লাল শেয়াল, পালা’স ক্যাট— লাদাখের দুর্গম পাহাড়ে এসব বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর দেখা পেতে কত কষ্টই না করতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু প্রতিবারই প্রাণীকে দেখামাত্র সব পরিশ্রম ভুলে যান অপরূপা।

আগামী প্রজেক্ট— ‘প্রজেক্ট চিতা’র দেশে

এ বার তাঁর লেন্স পৌঁছাবে মধ্যপ্রদেশের জাতীয় উদ্যানে। পৃথিবীর দ্রুততম প্রাণী চিতার জীবনচিত্র তুলে ধরা— এই তাঁর নতুন লক্ষ্য।
অপরূপার ভাষায়,
“প্রাণীর জীবনকথা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেই আমি লেন্স হাতে ঘুরি। প্রকৃতি আমার কাছে উৎসব।”