তেহরান জলবন্দি— দেড় কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে
ইরান জুড়ে এখন সর্বত্র আতঙ্ক— জল নেই, জীবন নেই! রাজধানী তেহরানের অবস্থা আরও ভয়াবহ। শহর জলে নিঃস্ব, খরার দাপটে শুকিয়ে কাঠ গোটা অঞ্চল। প্রশাসন ইতিমধ্যেই শুরু করেছে জল-রেশনিং, আর প্রেসিডেন্ট সরাসরি আর্জি জানিয়েছেন— রাজধানী ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার প্রস্তুতি নিন! কেন এমন বিপর্যয়? কী সেই ‘অভিশাপ’ যা মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিয়েছে পারস্য সভ্যতার কেন্দ্রকে?
জলশূন্য তেহরান: রুক্ষ মরুভূমির দিকে এগোচ্ছে শহর
গত ৬০ বছরে এমন ভয়ঙ্কর খরা দেখেনি ইরান।
- সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়নি।
- নভেম্বর–ডিসেম্বরে বৃষ্টির সম্ভাবনাও প্রায় নেই।
- বছরের উষ্ণতম শরৎ কাটিয়েছে দেশটি।
এর ফলে রাজধানীর জলাধারগুলির অবস্থা ধরাশায়ী—
- ৫টি প্রধান জলাধারের মধ্যে একটি পুরো শুকিয়ে গিয়েছে
- বাকিগুলির জলধারণ ক্ষমতা ৯২% কমে গেছে
- তাই মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত জলের কল বন্ধ রাখতে বাধ্য প্রশাসন
এই সংকটে দিনে দিনে বেড়ে চলেছে তেহরানের জল-দেউলিয়া অবস্থা।
দুই সপ্তাহের জল বাকি! সতর্ক করল কর্তৃপক্ষ
তেহরান রিজিয়োনাল ওয়াটার অথরিটির হিসাব চরম উদ্বেগজনক।
কারাজ বাঁধের জলাধারে মাত্র দু’সপ্তাহের পানীয় জল অবশিষ্ট।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মাশহাদেও জলাধারের ক্ষমতা তিন শতাংশের নিচে।
ফলে ৪০ লক্ষেরও বেশি মানুষ তীব্র জল-সংকটে।
প্রেসিডেন্টের বিস্ফোরক সতর্কবার্তা
২১ নভেম্বর ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান সরাসরি বলেন—
“এই মাসে বৃষ্টি না হলে তেহরানে জল বণ্টন আরও কঠোর করতে হবে। হয়তো পুরো রাজধানীই খালি করতে হবে। নাগরিকদের এখনই প্রস্তুত হতে অনুরোধ করছি।”
দেড় কোটির বেশি মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা তাই ক্রমেই বাস্তব হয়ে উঠছে।
জল-সঙ্কটের নেপথ্যে কোন অভিশাপ?
১. ভূগর্ভস্থ জলের অতি-ব্যবহার
নিক কাউসার নামের এক গবেষক বলেন,
“ইরানই নিজের জন্য ‘জল অভিশাপ’ ডেকে এনেছে।”
অপরিকল্পিত ভাবে বহু বছর ধরে গভীর কূপ খনন, অতিরিক্ত সরবরাহ ও বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প তেহরানের জলশয্যা হাড়িয়ে দিয়েছে।
২. মার্কিন নিষেধাজ্ঞার দগদগে ঘা
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ইরানের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিয়েছে।
ফলে আধুনিক জলশোধন ব্যবস্থা, বাঁধ উন্নয়ন— কিছুই করা যায়নি।
৩. ভৌগোলিক রুক্ষতা
ইরান মরুভূমি-প্রধান দেশ।
লবণাক্ত সমুদ্রজল পরিশোধনের প্রযুক্তি নেই—
যা আছে ইজ়রায়েল, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি— তিন দেশের সঙ্গেই তেহরানের বৈরিতা।
৪. জলবায়ুর ভয়াবহ পরিবর্তন
৮২% এলাকা আজ শুকনো বা আধা-শুকনো অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।
বৃষ্টি কম, তাপমাত্রা বাড়ছে— প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই অসম তরুণ পারস্যের।
৫. কৃষিক্ষেত্রে জল-নির্ভরতা
সেচেই খরচ হচ্ছে ৯০% ভূগর্ভস্থ জল!
জল-নির্ভর ফসল চাষ করায় কাঠের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকছে কৃষিনীতিই।
৬. প্রশাসনিক বৈষম্য
পশ্চিমি গণমাধ্যমের মতে, জাতিগত বৈষম্যের কারণে কিছু অঞ্চলে জল সরবরাহ কম করে তেহরান।
এর ফলেই এক অঞ্চলের জল অন্যত্র স্থানান্তর ও পরবর্তী বিপর্যয়।
রাজধানী বদল কি সমাধান? বিশেষজ্ঞদের সংশয়
রাজধানী সরানো সহজ নয়—
- দেড় কোটির বেশি মানুষকে সরানো প্রায় অসম্ভব
- তেহরান দেশের বাণিজ্যকেন্দ্র
- দূতাবাস স্থানান্তর বিরাট কূটনৈতিক প্রক্রিয়া
- নতুন শহর নির্মাণে লাগবে বিপুল অর্থ
তেহরানের সাবেক মেয়র গোলামহোসেইন কারবাশি তাই বলেন—
“প্রেসিডেন্ট নিশ্চয়ই মজা করেছেন। রাজধানী খালি করা সম্ভব নয়। সমাধানও নয়।”
শেষকথা: প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কিনারায় তেহরান
এই মুহূর্তে সাবেক পারস্যের রাজধানী দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জলসঙ্কটের সামনে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভুল নীতি, জলবায়ুর রোষ— সব মিলিয়ে দেড় কোটি মানুষের জীবন কি সত্যিই ঠেলে দেওয়া হচ্ছে অভিশপ্ত ভবিষ্যতের দিকে?
সময়ই জানাবে তেহরান কি মরুভূমির শহর হয়ে যায়, নাকি প্রকৃতি একদফা দয়া করে দেয়।

