জাপানের ‘বন্ড-বিস্ফোরণ’ কি বিশ্ববাজারে ভূমিকম্প তুলবে?
বিশ্ববাজারে নতুন আতঙ্কের নাম— জাপানি বন্ড সংকট। আর্থিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, জাপানের এই নীতি পরিবর্তন যেন “জাপানি বোমা”— যার অভিঘাতে কেঁপে উঠতে পারে আন্তর্জাতিক শেয়ার বাজার। বহু দেশ, বিশেষত ভারত, আমেরিকা ও ইউরোপের বাজার দীর্ঘদিন ধরে টিকে ছিল জাপানের শূন্য বা ঋণাত্মক সুদের হারের ওপর। সেই যুগ এক ঝটকায় শেষ হওয়ায় এখন বিশ্বব্যাপী বাড়ছে আশঙ্কা।
শূন্য সুদের যুগের অবসান— সংকটের সূচনা এখান থেকেই
প্রায় আট বছর ধরে জাপানে চলেছিল ঋণাত্মক সুদের হার। ২০১৬ সালে মন্দা গ্রাস করা অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক (Bank of Japan) এই নীতি নিয়েছিল।
কিন্তু ২০২৪ সালে বিওজে ঘোষণা করে— শূন্য থেকে ০.১% পর্যন্ত সুদের হার বাড়ানো হবে। এর অর্থ, ব্যাঙ্ক অফ জাপান আর আগের মতো জোরদার হারে সরকারি বন্ড কিনবে না।
এই সিদ্ধান্তের পরই—
- বন্ডের দাম কমছে
- ইল্ড বা সুদের হার বাড়ছে
- দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের চাহিদা ভয়াবহভাবে কমে গেছে
২০–৪০ বছরের জাপানি বন্ডের নিলামে সাম্প্রতিক সময়ে ঐতিহাসিক দুর্বল চাহিদা দেখা গিয়েছে।
জাপানের সমস্যা কোথায়?
জাপানের অর্থনীতি বহু দশক ধরেই বৈশ্বিক চিন্তার কেন্দ্র— কারণ:
- জনসংখ্যা দ্রুত বার্ধক্যের দিকে
- জন্মহার কম
- জিডিপির ২৫০%–রও বেশি ঋণ
- কোভিড, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা
এর মাঝে জাপান সরকার ঘোষণা করেছে ২১৩০ বিলিয়ন ইয়েন–এর আর্থিক প্রণোদনা। যা কিছুটা স্বস্তি দিলেও বন্ড বাজারের ওপর চাপ আরও বাড়িয়েছে।
বিওজে আর বন্ড কিনছে না— তাই দাম পড়ছে, ইল্ড বাড়ছে
এত দিন পর্যন্ত জাপানের সরকারি বন্ডের প্রায় ৭০% ছিল ব্যাঙ্ক অফ জাপানের কাছে।
এখন তারা মাসিক বন্ড কেনা ৬ ট্রিলিয়ন ইয়েন থেকে কমিয়ে ৩ ট্রিলিয়ন ইয়েনে নামাচ্ছে।
ফলে বাজারে বন্ড কিনতে কেউ না থাকায়—
- বন্ডের দাম পড়ে
- ইল্ড (সুদের হার) বাড়ে
ইল্ড বাড়লে জাপানি বিনিয়োগকারীরা দেশীয় বিনিয়োগে ঝুঁকতে শুরু করেন। এর ফলে বিদেশি বাজারে তাদের বিনিয়োগ কমে যেতে পারে।
ক্যারি ট্রেড বন্ধ হচ্ছে— বিশ্ববাজারে ঝড় আসতে পারে
বহু বছর ধরে বিদেশি শেয়ার বাজারে অর্থ ঢুকত একটি কারণে—
জাপান থেকে ০% সুদের হারে ঋণ নিয়ে (carry trade) আমেরিকা, ইউরোপ, ভারতসহ উচ্চ সুদের বাজারে বিনিয়োগ করতেন ট্রেডাররা।
এখন জাপানে সুদ বাড়ায়—
- পুরনো ঋণ শোধ করতে হবে
- বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রি করতে হবে
- বৈশ্বিক বাজারে বড় পতনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রথম ধাক্কাটা লাগবে—
- প্রযুক্তি শেয়ারে
- উচ্চ-ঝুঁকি সম্পদে
- উদীয়মান বাজারে
ভারতের জন্য কতটা বিপদ?
জাপান বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অন্যতম।
জাপানি বন্ডে সুদ আকর্ষণীয় হলে—
- তারা ভারতীয় শেয়ার ও বন্ড থেকে টাকা তুলে নিতে পারে
- ক্যারি ট্রেড কমে গেলে বিদেশি মূলধন বহির্গমন বাড়বে
- শেয়ার বাজারে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দিতে পারে
তবে ভারত সম্পূর্ণ ঝুঁকিতে নয়।
কেন?
- ভারতের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে
- জিডিপি বৃদ্ধির হার অনেক দেশের চেয়ে বেশি
- IMF–এর অনুমান: ২০২৫ সালে ভারতের বৃদ্ধি ৬.৬%, যেখানে বিশ্বের গড় বৃদ্ধি ৩.২%
- আমেরিকা, ইউরোপ, চীনের তুলনায় ভারতের সামষ্টিক অর্থনীতি এখন অনেক স্থিতিশীল
সুতরাং, আতঙ্ক নয়— নজরদারি জরুরি
জাপানের বন্ড ইল্ড বাড়লে বিশ্ববাজারে অস্থিরতা তৈরি হবেই। তবে ভারতের অর্থনীতি শক্ত ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে থাকায় বড় ধাক্কার সম্ভাবনা কম।
বিশেষজ্ঞদের ভাষায়— পরিস্থিতি নজরে রাখা দরকার, তবে এখনই অশনিসঙ্কেত নয়।
জাপানের নীতি বদল যে বৈশ্বিক আর্থিক তরঙ্গ তুলবে, তা স্পষ্ট— আর সেই তরঙ্গ থেকে ভারত কতটা অক্ষত থাকবে, এখন তাকিয়ে আছে গোটা বিশ্ব।

