বিদেশি সেনা ফেরানোর প্রস্তাবে প্রবল জনরোষ!
মাদক মাফিয়া ও নিষিদ্ধ চোরাচালানের দাপটে ক্ষতবিক্ষত ইকুয়েডর যখন এক গভীর নিরাপত্তা সঙ্কটে জর্জরিত, ঠিক তখনই দেশের পরিস্থিতি সামাল দিতে মার্কিন সেনা ফেরানোর উদ্যোগ নেন প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল নোবোয়া। প্রায় ১৭ বছর আগে যে বিদেশি বাহিনীর মোতায়েন সংবিধান অনুযায়ী নিষিদ্ধ হয়েছিল, সেই আইন পরিবর্তন করে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি পুনরায় ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি গণভোট ডাকেন। তাঁর আশা ছিল নাগরিকদের বড় অংশ এই প্রস্তাবকে সমর্থন করবেন। কিন্তু ফলাফল এল সম্পূর্ণ উল্টোমুখী—ইকুয়েডরের সাধারণ মানুষ রে-রে করে প্রত্যাখ্যান করলেন বিদেশি ফৌজের প্রত্যাবর্তনকে।
গত কয়েক বছর ধরে দেশে মাদক-চক্রের উত্থান ও গ্যাং–ওয়ার ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছে। প্রতিদিন বেড়ে চলেছে হত্যাকাণ্ড। এমন অবস্থায় নোবোয়া প্রশাসন মনে করেছিল, মার্কিন সেনার সহযোগিতা ফিরে পেলে দেশজুড়ে কোকেন পাচার ও কার্টেলদের দৌরাত্ম্য দমন সহজ হবে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নোবোয়ার অন্যতম প্রতিশ্রুতিও ছিল মাদকমাফিয়াদের পুরোপুরি নির্মূল। তবে বাস্তবে দেখা যায়, ক্ষমতায় আসার পর তাঁর প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য সাফল্য আনতে পারেনি। তাই তিনি আশা করেছিলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পূর্বের মতো ‘ড্রাগ–ওয়ার’ চালানো গেলে আবার নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
কিন্তু গণভোটের ফল প্রকাশের পর সে আশায় জল ঢেলে দেন দেশের নাগরিকেরা। অংশ নেওয়া ভোটারদের প্রায় ৬৫ শতাংশই স্পষ্ট জানিয়ে দেন—দেশের সার্বভৌমত্বের বিনিময়ে কোনও বিদেশি বাহিনী তাঁরা চান না। মার্কিন সামরিক উপস্থিতির বিরুদ্ধে ইকুয়েডরে বড় অংশের মানুষের প্রতিরোধ নতুন নয়। ১৯৯০–এর দশকের শেষ দিকে মান্তা বিমানঘাঁটিতে মার্কিন বাহিনী মোতায়েনের পর থেকেই বিতর্ক জোরদার হয়। আমেরিকার ড্রাগ–অভিযানের সময় বহু নিরীহ মৎস্যজীবীর মৃত্যু, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং স্থানীয় মানুষের জীবনে হস্তক্ষেপের ঘটনাগুলি সে সময় রাগ-ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেদিক থেকে দেখলে জনগণের এই সিদ্ধান্ত সেই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি।
১৯৯৯ সালের চুক্তি অনুযায়ী, ইকুয়েডর মান্তা বিমানঘাঁটির একটি বড় অংশ মার্কিন বাহিনীকে ব্যবহার করতে দিয়েছিল। বিনিময়ে তেমন কোনও আর্থিক সুবিধা আসেনি রাষ্ট্রের ঘরে। বরং সামরিক উপস্থিতির জেরে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে থাকে। ২০০৭ সালে বামপন্থী প্রেসিডেন্ট রাফায়েল কোরেয়া ক্ষমতায় আসার পর দেশজুড়ে প্রবল মার্কিন-বিরোধী আন্দোলনের সুরে তিনি সংবিধানে বিদেশি ফৌজ নিষিদ্ধ করার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন। ২০০৯ সালের মধ্যে মার্কিন সেনা পুরোপুরি ইকুয়েডর ছেড়ে চলে যায়।
এর পর থেকেই মাদক পাচার ফের বৃদ্ধি পেলেও সাধারণ মানুষ বিদেশি সেনা ফেরাতে কখনওই আগ্রহী ছিলেন না। কারণ, তাঁদের বিশ্বাস—এই বাহিনীর আগমন মানে দেশের ওপর আমেরিকার নজরদারি, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপ। গণভোটে সেই অবস্থানই আবারও প্রমাণিত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্পের অনিয়মিত নীতি, হঠাৎ হঠাৎ সিদ্ধান্ত বদল এবং লাতিন আমেরিকায় অতীত মার্কিন ভূমিকাই ইকুয়েডরের নাগরিকদের আরও সতর্ক করে তুলেছে। জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল শিফটার মন্তব্য করেছেন, “এই রায় বলছে, ইকুয়েডরবাসী স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনও আপস করতে রাজি নয়।”
দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি এখনও অতি জটিল। নোবোয়া প্রশাসন মাদকচক্র দমনে লাগাতার জরুরি অবস্থা জারি করছে, অভিযান চলছে বহু এলাকায়। তবে গণভোটের স্পষ্ট বার্তা—বহিরাগত সেনা নয়, নিজেদের শক্তি ও নীতিতেই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে ইকুয়েডরকে।

