দ্রৌপদী মুর্মুর পাঠানো ১৪ প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের বিস্তারিত ব্যাখ্যা!
ভারতের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালের ভূমিকায় একাধিক সূক্ষ্ম ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিশেষত কোনও রাজ্যের বিধানসভায় পাশ হওয়া বিল নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের করণীয় নিয়ে বহু দিন ধরেই বিতর্ক ও বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছিল। এই প্রেক্ষাপটেই রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু সুপ্রিম কোর্টে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪৩ অনুযায়ী ১৪টি প্রশ্ন পাঠান, যাতে বিল অনুমোদন, সময়সীমা, এবং আদালতের হস্তক্ষেপের পরিসর স্পষ্ট হয়।
গত জুলাই থেকে প্রধান বিচারপতি বিআর গগৈয়ের নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চ এই ‘প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্স মামলার’ শুনানি শুরু করে। শেষ পর্যন্ত ১৪টির মধ্যে ১১টি প্রশ্নের উত্তর দেয় আদালত, যা ভবিষ্যতে কেন্দ্র–রাজ্য সম্পর্ক, আইন প্রণয়ন এবং সাংবিধানিক সংস্থাগুলির ক্ষমতা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে।
রাষ্ট্রপতি যে ১৪টি প্রশ্ন তুলেছিলেন
রাষ্ট্রপতির প্রশ্নগুলির মধ্য থেকে কিছু প্রধান বিষয় ছিল—
- রাজ্যপাল কোন কোন বিকল্প প্রয়োগ করতে পারেন?
- তিনি কি মন্ত্রিসভার পরামর্শ মানতে বাধ্য?
- আদালত কি রাজ্যপালের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করতে পারে?
- রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত কি বিচারযোগ্য?
- আদালত কি সময়সীমা নির্ধারণ করতে পারে?
- রাজ্যপালের সম্মতি ছাড়া কোনও বিল কি আইন হতে পারে?
এই প্রশ্নগুলির উত্তর স্পষ্ট করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ ও রায়: মূল পয়েন্টগুলি
১. রাজ্যপালের তিনটি বিকল্পই সংবিধানে নির্দিষ্ট
বিল রাজ্যপালের কাছে গেলে তাঁর সামনে মাত্র তিনটি সাংবিধানিক পথ খোলা—
১) সই করা
২) রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো
৩) মন্তব্যসহ বিধানসভায় ফেরত পাঠানো
চতুর্থ কোনও বিকল্প নেই। আদালত স্পষ্ট করে দেয়, বারবার বিল ‘হোল্ড’ করে রাখা কোনওভাবেই সংবিধানসম্মত নয়।
২. ২০০ ধারায় রাজ্যপালের কিছু ‘বিবেচনাধিকার’ আছে
মন্ত্রিসভার পরামর্শ সব সময় মানতে হবে— এমন নয়। তবে এই বিবেচনা হবে যুক্তিসঙ্গত ও সীমাবদ্ধ; ব্যক্তিগত মত নয়।
৩. সিদ্ধান্ত বিচারযোগ্য নয়, তবে ‘অযথা দেরি’ আদালতের নজরদারির আওতায়
রাজ্যপালের সিদ্ধান্তের মেরিট আদালত বিচার করতে পারবে না।
তবে—
রাজ্যপাল যদি ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করেন, বা কোনো কারণ ছাড়াই নিষ্ক্রিয় থাকেন, আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং বলতে পারে— “যথাশীঘ্র সিদ্ধান্ত নিন”।
৪. ৩৬১ ধারা রাজ্যপালকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা দেয়, পদকে নয়
রাজ্যপালের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত মামলা করা যাবে না।
কিন্তু তাঁর অফিস আদালতের আওতায় থাকবে, এবং নিষ্ক্রিয়তার জবাবদিহি আদালতে করতে হবে।
৫. রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তও বিচারযোগ্য নয়
২০১ ধারার অধীনে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তও আদালত ‘মেরিট’-এর ভিত্তিতে পরীক্ষা করবে না। তবে তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যায় কি না— সে প্রশ্নে আদালত বলেছে, আদালত রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপালকে বাধ্যতামূলক সময়সীমায় বেঁধে দিতে পারে না।
৬. রাষ্ট্রপতি আদালতের মতামত চাইতে বাধ্য নন
১৪৩ ধারায় মতামত নেওয়া সম্পূর্ণ রাষ্ট্রপতির বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল। রাজ্যপাল বিল পাঠালেই প্রেসিডেন্ট কোর্টের মতামত নেবেন— এমন বাধ্যবাধকতা নেই।
৭. বিল আইন হওয়ার আগে আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারে না
সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট জানায়—
বিল আইন হওয়ার আগে তার বিষয়বস্তু বা অনুমোদন প্রক্রিয়া নিয়ে আদালতে মামলা করা যাবে না।
৮. রাজ্যপালের সম্মতি ছাড়া কোনও বিল ‘আইন’ নয়
রাজ্যপালের সই বাধ্যতামূলক।
রাষ্ট্রপতির সই প্রয়োজন হয় তখনই, যখন রাজ্যপাল সেই বিল প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠান।
শেষ কথা
এই রায় রাজ্যপাল ও রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে স্বচ্ছতা আনে, ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করে এবং কেন্দ্র–রাজ্য সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কাঠামোকে স্পষ্ট করে। একই সঙ্গে আদালত জানিয়েছে— সংবিধানে যা নেই, আদালত তা সৃষ্টি করতে পারে না।
অর্থাৎ ‘ডিমড অ্যাসেন্ট’ বা সময়সীমা চাপানো— সবই সংবিধানের পরিপন্থী।

