হাসিনার ফাঁসির রায় ঘিরে স্মৃতির সরণিতে ফিরে দেখা
পনেরো বছর আগের সেই মুহূর্ত— ঢাকার এক রাজনৈতিক পরিবেশ, উচ্ছ্বসিত জনতা, মঞ্চে সদ্য নির্বাচনে বিজয়ী শেখ হাসিনা। সবার মাঝে হাস্যরসের ছলে উচ্চারিত সেই বাক্য, “মাইর দিব”— তখন ছিল নিছকই স্নেহের সুরে বলা একটি জনপ্রিয় মন্তব্য। কিন্তু ২০২৫ সালের নভেম্বরের সোমবার দুপুরে যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল তাঁর ফাঁসির রায় ঘোষণা করল, তখন যেন সেই বহু পুরনো কথাটাই ব্যঙ্গের মতো ফিরে এসে দাঁড়াল সময়ের সামনে। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস— মনে হয়, কথাটি যেন তাঁরই দিকে ফিরে তাকাল।
স্মৃতি আরও উসকে উঠল সাংবাদিক অনিন্দ্য জনার মনে। ২০০৮ সালের শেষ দিনটি তাঁর মনে গেঁথে আছে। ঢাকার শের-এ-বাংলা নগরের ‘চীন-বাংলাদেশ সম্মেলন কেন্দ্র’ তখন সাংবাদিক, কূটনীতিক ও আওয়ামী লীগের অসংখ্য কর্মী-সমর্থকে ভরা। সাংবাদিক সম্মেলনের চেয়ে বেশি যা চলছিল তা হল বিজয়োৎসব। আগের দিনই নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হয়েছে— খালেদা জিয়ার বিএনপিকে পিছনে ফেলে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ‘ভূমিধস জয়’। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও লিখছিল— “ল্যান্ডস্লাইড ভিক্টরি”।
বাংলাদেশে ভোটগণনা কখনই তাড়াতাড়ি শেষ হয় না। সেই সময় তো ব্যালটপেপারে ভোট। সকাল থেকে রাত— কখনও রাতভর— গোনা চলতেই থাকে। কিন্তু আন্তর্জাতিক দৈনিকের কাছে অপেক্ষার সুযোগ নেই। সেই কারণে সাংবাদিক অনিন্দ্য রাতেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন রিপোর্ট— “ভূমিধস জয় নিশ্চিত” শিরোনামে। পরদিনের প্রথম পাতায় সেটিই ‘লিড’ হওয়ার কথা। কিন্তু ভোরবেলায় ফোন এলো সম্পাদক মহাশয়ের— “গণনা শেষ হয়নি, এত তাড়াতাড়ি ল্যান্ডস্লাইড লিখলে চলে?” লেখকের সাফাই, তথ্যপ্রবাহ দেখে বোঝাই যাচ্ছিল ফলাফল কোনদিকে যাবে। সৌভাগ্যবশত, ফলাফল তাঁর লেখা মিলেই ছিল— এবং সেদিন চাকরিও টিকে যায়।
সন্ধ্যায় ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ দফতরে প্রথম মুখোমুখি দেখা হল হাসিনার সঙ্গে। তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার অপেক্ষায়। ছোট্ট বাড়ির সামনে কড়া নিরাপত্তা, ভেতরে তুমুল ভিড়— দেশি বিদেশি সাংবাদিক, দলের নেতা, সমর্থক সবাই যেন বিজয়ের উচ্ছ্বাসে ভেসে যাচ্ছেন। বিদেশি কূটনীতিকেরা আসছেন একে একে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হটলাইন খোলার উদ্দেশ্যে। হাসিনা তখন শান্ত, সংযত, তবে স্পষ্টতই আত্মবিশ্বাসী।
এই দৃশ্যগুলোর সঙ্গে ২০২৫ সালের নভেম্বরের ভয়াবহ রায়ের দিনের দৃশ্য যেন দুই প্রান্তের গল্প— একটি সীমাহীন বিজয়ের প্রতীক, অন্যটি তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাতের প্রতিচ্ছবি। গণবিক্ষোভ, অস্থায়ী সরকারের ক্ষমতা দখল, অনুপস্থিত অবস্থায় বিচার— সব মিলিয়ে আজকের পরিস্থিতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব অধ্যায়।
হাসিনা বর্তমানে ভারতে আশ্রয় নিয়ে রয়েছেন। আর ঢাকায় আদালতের ফাঁসির রায় ঘোষণা করা হয়েছে তাঁর অনুপস্থিতিতেই। দেশজুড়ে সহিংসতা, দমননীতি, এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগে এখন উত্তপ্ত পুরো দক্ষিণ এশিয়া। কেউ বলছেন— এটি ন্যায়বিচার নয়, রাজনৈতিক প্রতিশোধ। আবার অন্য অংশের মত— অতীতের অপশাসনের প্রতিদান দিয়েছেন জনগণ।
কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়— রাজনৈতিক উত্থান ও পতনের খেলায় সময় বড় নির্মম। ২০০৮ সালে ‘মাইর দিব’-এর রসিকতা যাঁকে জয় করে দিয়েছিল জনতার মন, ২০২৫ সালে সেই মানুষটিই শুনছেন মৃত্যুদণ্ডের রায়। একটি বাক্য, একটি মুহূর্ত— যা আজ যেন প্রতিধ্বনিত করে এক যুগের বৈপরীত্য।
সময়ের স্রোতে সেই কথাটাই যেন এখন ছায়ার মতো এসে দাঁড়াচ্ছে—
“মাইর দিব” — কথাগুলো আজ আর হাসির সুরে শোনা যায় না, ইতিহাসের বিচারে যেন তা হয়ে উঠেছে এক অদ্ভুত পরিহাসের প্রতীক।

