অসীম স্নেহে মোড়া জন্মদিন!
বিমানবন্দরে নামতেই যেন স্পষ্ট হয়ে গেল—জ়ুবিন গার্গ নেই, তা সত্যি হলেও তিনি কোনও ভাবেই Assam–এর মানুষের হৃদয়ে ‘অতীত’ হননি। বরং আজও তিনি ততটাই জীবন্ত, যতটা কোনও প্রাণের শিল্পী থাকেন তাঁর ভক্তদের অন্তরে। গোটা অসম যেন থমকে আছে তাঁর স্মৃতিচারণে, তাঁর ৫৪তম জন্মদিন উদ্যাপনে। এই দৃশ্য দেখে মনে হয়, জীবনে কয়েক দশকের শিল্পসাধনা ছাড়াও, মানুষ হিসেবে কত গভীর প্রভাব ফেললে এমন উদ্যাপন দেখা যায়!
স্কুল থেকে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসকদের সংগঠন—সকলেই ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন এই কিংবদন্তিকে। কারণ তিনি শুধু এক জন গায়ক, সুরকার বা অভিনেতা ছিলেন না; তিনি ছিলেন মানুষের শিল্পী। সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার, তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর যে ক্ষমতা জ়ুবিনের ছিল, তা তাঁকে আজ আরও অমলিন করে রেখেছে।
গরিমার নীরব শোক, অসমের অশ্রুসিক্ত শ্রদ্ধা
জ়ুবিনের স্ত্রী গরিমা গার্গ শইকীয়া হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন দিন দুই। শোকে অবশ, কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষের ভালবাসার যে ঢেউ তাঁর ঘরের নীচে থেমে নেই, তা দেখে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে যান।
তাঁদের আবাসনের নিচে গরিমা নিজে সুন্দর করে সাজিয়েছেন জ়ুবিনকে উৎসর্গ করা একটি ছোট স্মৃতিমঞ্চ—নীল, সাদা ও সোনালি বেলুনে ভরা, ফুলে ঢাকা জ়ুবিনের ছবি, সামনে শ্রদ্ধা জানাতে ভিড়।
যে দম্পতি দশকের পর দশক সঙ্গীত, সংগ্রাম ও ভালবাসায় দিন কাটিয়েছেন, আচমকা এমন ক্ষতি যে গরিমাকে প্রায় নিস্তব্ধ করে দিয়েছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাঁর চোখে জল, তবু সবার প্রতি শান্ত, নীরব অভিবাদন।
মূক-বধির শিশুদের উপস্থিতি—জ়ুবিনের ‘অজানা মানবিকতা’র প্রমাণ
এই শ্রদ্ধার মাঝে হঠাৎই একটি দৃশ্য গভীরভাবে নাড়িয়ে গেল সবাইকে—একদল মূক-বধির শিশু গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসে। ইশারায় জানায়, তারা কথা বলতে পারে না, কিন্তু জ়ুবিনকে খুব ভালবাসে।
পরে জানা যায়, এই সব শিশুর দায়িত্ব নীরবে পালন করতেন শিল্পী নিজেই। কখনও কাউকে জানাননি। কোনও প্রচার নয়, কোনও অহমিকা নয়—এটাই ছিল জ়ুবিনের চরিত্র।
তাই তাঁর প্রয়াণের পরও তাঁর মানবিকতা হাজার চোখে জল আনে।
অসমের প্রতিটি রাস্তা যেন এক স্মৃতি–যাত্রাপথ
গুয়াহাটির রাস্তায় রাস্তায় সর্বত্র জ়ুবিনের ছবি, পোস্টার, ক্যালিগ্রাফি, দেওয়ালজোড়া মুরাল। মানুষ ফুল দিচ্ছেন, মোমবাতি জ্বালাচ্ছেন, থেমে দাঁড়াচ্ছেন। যেন প্রত্যেকে নিজের মতো করে তাঁর স্মৃতিকে ছুঁয়ে যেতে চাইছেন।
তাঁর সমাধিস্থলেও ভিড়ের অন্ত নেই। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ, হাতে ফুল, চোখে অশ্রু—এই দৃশ্যই বলে দেয়, কোনও শিল্পী কতটা গভীরে স্থান নিতে পারলে এমন দৃশ্য তৈরি হয়।
অসমের হৃদয়ের শিল্পী, তাই আজও ‘জীবন্ত’
শিল্পী হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা বিশাল হলেও, অসম আজ যাঁকে স্মরণ করছে, তিনি শুধু তারুণ্যের আইকন, রকস্টার বা গায়ক নন—তিনি এক মানবিক, সহজ-সরল, মানুষের শিল্পী। তাই তাঁর জন্মদিন যেন রাজ্যের জন্মদিনের মতোই উদ্যাপিত হচ্ছে।
অসম বছরের পর বছর তাঁকে মনে রাখবে—গানে, স্মৃতিতে, ভালবাসায়। আর এই উদ্যাপন প্রমাণ করে দিল, কেউ কেউ চলে যান শারীরিক ভাবে, কিন্তু থাকেন আজীবন মানুষের হৃদয়ে।

