কীভাবে ফাঁস হল হিডমার গতিবিধি, সন্দেহের তির মাওবাদীদেরই এক শীর্ষ নেতার দিকে!
ছত্তীসগঢ়–অন্ধ্র–তেলঙ্গানার ত্রিসীমানায় বহু বছর ধরেই মাওবাদী গেরিলা বাহিনীকে লাগাতার চাপ দিয়ে আসছে কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথবাহিনী। গত এক দশকে যাঁর নেতৃত্বে মাওবাদীরা একের পর এক মরণঘাতী হামলা চালিয়েছে, সেই সিপিআই (মাওবাদী)-র কেন্দ্রীয় কমিটির তরুণতম সদস্য মাধবী হিডমা মঙ্গলবার পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ায় ফের উঠেছে ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ অভিযোগ। নিরাপত্তাবাহিনী এত সহজে কী ভাবে খোঁজ পেল জাতীয় স্তরে ‘সবচেয়ে অধরা’ এই মাওবাদী কমান্ডারের? মাওবাদী মহল থেকেই উঠে আসছে একাধিক আশঙ্কাজনক তথ্য।
হিডমার মৃত্যু চাঞ্চল্য ছড়ালেও তদন্তকারী মহলের মতে, মাওবাদী সংগঠনের অভ্যন্তরেই চলছে বড়সড় ভাঙন। ওই ফাটলের মাঝেই হিডমার অবস্থানের গোপন তথ্য এসে পৌঁছয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে। গত ১৪ অক্টোবর গঢ়চিরৌলিতে আত্মসমর্পণ করেন মাওবাদী পলিটব্যুরোর সদস্য মাল্লোজুলা বেণুগোপাল রাও ওরফে ভূপতি, যিনি কিষেণজির ভাই হিসেবেও পরিচিত। তাঁর সঙ্গেই আত্মসমর্পণ করেন প্রায় ৬০ জন মাওবাদী। মাওবাদীদের একাংশের দাবি—ভূপতির কাছ থেকেই পাওয়া গিয়েছে হিডমার অবস্থান ও গতি–প্রকৃতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র।
শুধু ভূপতি নন, পিএলজিএ-র ১ নম্বর ব্যাটালিয়নের এক প্রশিক্ষিত কমান্ডার ওয়াম লাকমুরও গত অক্টোবরে আত্মসমর্পণের পর জানিয়েছিলেন যে দক্ষিণ বস্তারে লাগাতার অভিযানের জেরে হিডমা শতাধিক গেরিলাসহ তেলঙ্গানা–অন্ধ্র সীমান্তের অরণ্যে আশ্রয় নিয়েছেন। এই দুই তথ্য মিলিয়েই যৌথবাহিনী হিডমার গতিবিধি নির্দিষ্ট করে ফেলে বলে মনে করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার ভোরে অন্ধ্রপ্রদেশের আলুরি সীতারামরাজু জেলার মারেদুমিলি জঙ্গলে সিআরপিএফের কোবরা কমান্ডো, অন্ধ্র–তেলঙ্গানা–ছত্তীসগঢ়—তিন রাজ্যের পুলিশ যৌথভাবে অভিযান চালায়। গুলির লড়াইয়ে হিডমা ছাড়াও নিহত হন তাঁর স্ত্রী মদাকম রাজে এবং আরও চার জন। সকলেই পিএলজিএ-র সক্রিয় সদস্য। সরকারি ভাবে কিছু প্রকাশ না হলেও অভিযানের গোড়ায় যে ‘ইনপুট’ ছিল অত্যন্ত নির্ভুল, তা স্পষ্ট।
একই দিনে অন্ধ্র পুলিশ ‘অপারেশন অক্টোপাস’ চালিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে ৩১ জন মাওবাদীকে গ্রেফতার করেছে। অন্ধ্র পুলিশের এডিজি মহেশচন্দ্র লাড্ডা জানান— এঁদের বেশিরভাগই ছত্তীসগঢ় থেকে পালিয়ে এ রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
হিডমার উত্থান মাওবাদী সংগঠনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। সুকমার জনজাতি অধ্যুষিত পুবর্তী গ্রামের ছেলে হিডমা নয়ের দশকে সংগঠনে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে পিএলজিএ-র ১ নম্বর ব্যাটালিয়নকে ২৫০ জনের বাহিনী নিয়ে নেতৃত্ব দেন। তাঁর নির্দেশেই ২০১০ সালে দন্তেওয়াড়ায় ৭৬ জন সিআরপিএফ জওয়ান নিহত হন। ২০১৩-র জিরম ঘাঁটি হত্যাকাণ্ড, ২০২১–এর ২২ জন নিরাপত্তাকর্মী হত্যার ঘটনাতেও অন্যতম ষড়যন্ত্রী ছিলেন তিনি। তাঁর মাথার দাম ধাপে ধাপে বাড়তে বাড়তে পৌঁছেছিল ১ কোটি টাকায়।
গত কয়েক বছরে বাসবরাজু, সুধাকর–সহ মাওবাদীদের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা সংঘর্ষে মারা গেছেন। অনেকে আত্মসমর্পণ করেছেন। ফলে সংগঠনে নেতৃত্বের সংকটের পাশাপাশি ভাঙনও স্পষ্ট। এই অবস্থায় হিডমার মৃত্যুকে বড় ধাক্কা বলে মনে করছে গোয়েন্দা দফতর।
এখন নজর নিরাপত্তা বাহিনীর সামনে অধরা থাকা আরও কয়েকজন শীর্ষ নেতার দিকে—বিশেষত সাধারণ সম্পাদক থিপ্পিরি তিরুপতি, পলিটব্যুরো সদস্য মিসির বেসরা এবং পিএলজিএ কমান্ডার গণেশ উইকে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নির্ধারিত সময়সীমা অনুযায়ী— মাওবাদী দমনে এ বার আরও কঠোর হবে যৌথবাহিনী।

