নারীবাদ কি শুধুই হাসি-ঠাট্টার বিষয়?
একদিকে বলা হয়, “মেয়েরা অর্ধেক আকাশ”—অন্যদিকে, ব্যঙ্গাত্মক প্রশ্ন ওঠে, “নাসা এখনও চাঁদে মেয়েমানুষ পাঠায়নি কেন? কারণ চাঁদে রান্নাবান্নার কাজ নেই!”
নারীবাদ নিয়ে এমন ঠাট্টা-বিদ্রুপ যেন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোথাও নারীবাদীদের নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক মিম, কোথাও আবার রসিকতা করে বলা হয়, “ফেমিনিজম বেশি করো না!” সমাজে নারীবাদ নিয়ে এত হাসাহাসি, এত বিরোধিতা কেন?
নারীবাদ মানেই কি বিদ্রুপের বিষয়?
প্রায় দশ বছর আগে আমার এক বুদ্ধিদীপ্ত, বিচক্ষণ বন্ধু আচমকাই বলেছিলেন, “বেশি ফেমিনিস্ট ফেমিনিস্ট কথা বোলো না তো!” তখন আমি ভেবেছিলাম, যাঁরা প্রগতিশীল, সমানাধিকারের পক্ষে কথা বলেন, তাঁরা সবাই নারীবাদীও বটে। পরে বুঝলাম, ‘নারীবাদী’ শব্দটি অনেকের কাছেই যেন গালির সমান!
নাইজেরীয় লেখিকা চিমানান্দা আদিচি তাঁর বই ‘We Should All Be Feminists’-এ বলেছেন, “আমাদের সবারই নারীবাদী হওয়া উচিত।” কারণ, নারীবাদ মানেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমান অধিকারের দাবিতে দাঁড়ানো। কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে, নারীবাদী চেতনা আজও সমাজের চোখে এক অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নারীবাদ কেন সমাজের জন্য ‘বিপজ্জনক’?
নারীবাদীরা যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেন, সেগুলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্বাচ্ছন্দ্য নষ্ট করে। যেমন—
- সমান মজুরির দাবি
- গৃহশ্রমকে শ্রম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া
- যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে কঠোর আইন
- বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা
- প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌনপরিচয়ের স্বীকৃতি
এসব দাবি সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একপ্রকার প্রতিবাদ। নারীবাদীদের ঠাট্টা-মশকরার পেছনে কারণ একটাই—তাঁদের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করা।
ঠাট্টার আড়ালে লুকিয়ে থাকা হিংসা
শুধু শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনই নয়, নারীবাদীদের প্রতি বিদ্রুপও একধরনের হিংসা। কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার ঘটনা যখন সামনে আসে, তখন অনেকেই বলেন, “এত কঠিনভাবে নিও না, ঠাট্টাই তো করছি!” কিন্তু সত্যিই কি তা শুধুই ঠাট্টা?
ভারতে গৃহহিংসা বিরোধী আইন নিয়েও আজকাল অনেকেই রসিকতা করেন। কারণ, যেখানে মারধর করা যায় না, চোখ রাঙানো যায় না, সেখানে ব্যঙ্গ করাই তো পুরুষতন্ত্রের একমাত্র হাতিয়ার!
সংসার কি শুধুই নারীর গুণে সুখের?
টিভিতে একদিন দেখলাম বাংলা ধারাবাহিকের নাম—“সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে”। মূর্তিমান নারীবাদী নিরানন্দ হিসাবে আমি বলব—
- “শুধু নারীর গুণে কেন? সংসার সুখের হবে নারী-পুরুষ উভয়ের সমান দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে!”
- “সংসার যদি নারীর জন্য শুধুই সহিংসতা আর বঞ্চনার জায়গা হয়, তবে সে কি সত্যিই সুখের?”
- “নারী কেন শুধু সংসারের গণ্ডিতেই আবদ্ধ থাকবে? তারও তো সমগ্র বিশ্বকে জানার অধিকার রয়েছে!”
নারীবাদ কি শুধুই বিরক্তির কারণ, নাকি সমাজ বদলের হাতিয়ার?
নারীবাদ নিয়ে এত বিদ্রুপ, এত হাসাহাসির উদ্দেশ্য একটাই—নারীদের চুপ করিয়ে দেওয়া। বিংশ শতাব্দীতে মেয়েরা পড়াশোনা করলে ব্যঙ্গ করা হতো, চাকরি করলে বলা হতো “সংসার ভাঙবে”। আজও কর্মক্ষেত্রে সফল নারীদের বলা হয়, “এত সিরিয়াস কেন, একটু হালকা হও!”
১৯৭০-এর দশকের জনপ্রিয় স্লোগান ছিল, “A woman needs a man like a fish needs a bicycle”—অর্থাৎ, “নারীর যতটা পুরুষের প্রয়োজন, মাছেরও ঠিক ততটাই সাইকেলের প্রয়োজন!” নারীরা তাদের নিজস্ব পরিচয়ে, নিজস্ব শক্তিতে পূর্ণ। তাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যতই হাসি-ঠাট্টার মোড়কে নারীবাদকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করুক, সত্যিটা বদলাবে না—নারীবাদ কেবলই ‘বিদ্রুপের বিষয়’ নয়, বরং এটি সমাজ বদলের হাতিয়ার!
ভারতের উপর পাল্টা শুল্ক চাপাচ্ছেন ট্রাম্প! ঘোষণা করলেন নির্দিষ্ট তারিখও

