যাদবপুর এক আলাদা জগৎ!
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়—৬০ একর জায়গা নিয়ে এক অন্য জগৎ। বাইরে শহর বদলাচ্ছে, রাজনীতির সমীকরণ বদলাচ্ছে, কিন্তু এই পাঁচিলঘেরা প্রাঙ্গনের ভেতরে সময় যেন থমকে আছে। বাইরের উত্তাল রাজনৈতিক হাওয়া এখানে পৌঁছয় না। বিজেপি গত কয়েক বছরে যাদবপুর ও সংলগ্ন এলাকায় উল্লেখযোগ্যভাবে তাদের প্রভাব বাড়িয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে তাদের উপস্থিতি প্রায় শূন্য। কেন?
বাইরের রং ভিতরে ঢোকে না
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন বরাবরই লাল রঙে রাঙানো। এখানে বামপন্থী মতাদর্শের বিভিন্ন ধারার মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও, বাইরের যে কোনো রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে তারা ঐক্যবদ্ধ। বিজেপি ও তাদের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি (অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ) বহুবার ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করেছে, বিশেষত ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অবাংলাভাষীদের মধ্যে সংগঠন গড়ে তোলার মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিবারই তারা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, যাদবপুরের ভেতরে এক সুসংগঠিত “বাম বাস্তুতন্ত্র” রয়েছে, যেখানে সংসদীয় রাজনীতির বাইরের আদর্শগত বিতর্কই প্রাধান্য পায়।
একসময় সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআই-ও যাদবপুরে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারেনি, কারণ বাম রাজনীতির মধ্যেও এখানে মতপার্থক্য ছিল। ফলে বিজেপির মতো দল, যারা ‘জাতীয়তাবাদ’ বা ‘ধর্মীয় মেরুকরণ’-এর ওপর ভিত্তি করে রাজনীতি করে, তারা এই পরিসরে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারেনি।
যেখানে বিজেপির উত্থান, যেখানে পতন
যাদবপুরের বাইরের অঞ্চল—বাঘাযতীন, গাঙ্গুলিবাগান, সন্তোষপুর, বিজয়গড়, আজাদগড়, বাঁশদ্রোণী, টালিগঞ্জ, নেতাজিনগর—কখনো ছিল বাম দুর্গ। কিন্তু গত দশকে সেখানে বিজেপির শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের পরেই বিজেপি ছিল দ্বিতীয় স্থানে। এর কারণ কী?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অঞ্চলের উদ্বাস্তু কলোনিগুলো বিজেপির উত্থানের মূল ভিত্তি। পূর্ববাংলা থেকে আসা উদ্বাস্তুদের মধ্যে বিজেপি নিজেদের জায়গা করে নিতে পেরেছে। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘বাংলায় হিন্দু উদ্বাস্তুদের আশ্রয়’ দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে বিজেপি এই সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় করতে পেরেছে। তাই বাইরের রাজনৈতিক মানচিত্রে বিজেপির শক্তি বাড়লেও, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচিলের ভেতরে তারা জায়গা করে নিতে পারেনি।
তৃণমূলও পিছিয়ে, কিন্তু কিছুটা এগিয়ে
যাদবপুরের রাজনীতিতে শুধু বিজেপিই নয়, তৃণমূলও সুবিধা করতে পারেনি। টিএমসিপি (তৃণমূল ছাত্র পরিষদ) বহুবার সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও, কোনো দৃশ্যমান প্রভাব ফেলতে পারেনি। তবে বিজেপির তুলনায় তৃণমূলের প্রভাব কিছুটা হলেও বেশি। ছাত্র রাজনীতিতে বামদের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা বিজেপির চেয়ে বেশি জায়গা দখল করতে পেরেছে।
যাদবপুর বনাম জেএনইউ: দুটি ভিন্ন বাস্তবতা
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ)-এ বাম ছাত্র সংগঠন ও এবিভিপির মধ্যে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। কিন্তু যাদবপুরে এবিভিপি এখনো ক্যাম্পাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। আবার জেএনইউ-এর বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর দিল্লির রাজনীতিতে খুব একটা প্রভাব নেই, যেমন যাদবপুরের ক্ষেত্রেও ক্যাম্পাসের রাজনীতি পাঁচিলের বাইরে গিয়ে বিশেষ প্রভাব ফেলে না।
শেষ কথা
২০১৯ সালে বাংলার বিভিন্ন উদ্বাস্তু এলাকায় বিজেপি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যাদবপুরের বাইরেও বিজেপির উত্থান অব্যাহত ছিল ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট পর্যন্ত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে এখনো তারা প্রবেশ করতে পারেনি। এখানকার রাজনীতি এক ভিন্ন বাস্তবতার প্রতিফলন—যেখানে মতাদর্শই মুখ্য, যেখানে বাইরের পরিবর্তন খুব একটা ছাপ ফেলতে পারে না। তাই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বিজেপির কাছে এখনো এক ‘ভিন্ন গ্রহ’, যেখানে তাদের জন্য কোনো জায়গা নেই।
ইউক্রেনকে আর সামরিক সাহায্য নয়! ট্রাম্পের কড়া বার্তা, চাপে জেলেনস্কি

