মহামানবের মহাতীর্থে একাকার পুণ্য !
প্রয়াগরাজের মহাকুম্ভ মেলা এক অদ্ভুত তীর্থযাত্রার অভিজ্ঞতা। যেখানে পুণ্য লাভের ইচ্ছায় লক্ষ লক্ষ মানুষ গঙ্গা, যমুনা এবং সরস্বতী নদীর ত্রিবেণী সঙ্গমে স্নান করতে আসেন। কিন্তু এর চেয়েও বেশি কিছু আছে। প্রতি বছর, বিশেষ করে পূর্ণকুম্ভ এবং মহাকুম্ভ মেলায়, লক্ষাধিক মানুষের পদচারণা ও ধর্মীয় অনুভূতিতে এক অদ্ভুত সুরেলা মিলন ঘটে। তবে, এই মিলনের উদ্দেশ্য কী? মেলা দেখে, অনুশীলন ও সাধনার মধ্যে সেই প্রশ্ন জাগে: মহাকুম্ভ কি শুধুই ধর্মীয় উৎসব, নাকি এর গভীরে রয়েছে মানব জীবনের উদ্দেশ্য অনুসন্ধান?
প্রথমে বলতে হয়, মহাকুম্ভের অর্থ বা তা কীভাবে গড়ে উঠল তা জানা জরুরি। কুম্ভ শব্দের অর্থ কলস। এটি একটি প্রতীকী পাত্র, যার মধ্যে অমৃত রাখা হয়েছিল। ‘কুম্ভ’ বা কলসের সেই অমৃত নিয়েই বহু কাহিনী, মহাকাব্য ও পুরাণ ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে এই মেলার ঐতিহ্য। ‘মহাভারত’ কিংবা ‘ভগবত পুরাণ’-এ এই অমৃতের উৎসবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই অমৃত কুম্ভে যে ধর্মের মেলবন্ধন, সেই সঙ্গমেই পূর্ণতা পায় মনের আরাধনা। স্বয়ং বিষ্ণু ছিলেন এই মহামিলনের নিয়ন্তা, যখন তিনি মোহিনী রূপে অসুরদের চেয়ে দেবতাদের অমৃত পাত্র দান করেছিলেন। তখনই শুরু হয় তীর্থ যাত্রার শাশ্বত ঐতিহ্য।
আমাদের জীবনে কখনও কখনও, ছুটির দিনগুলোতে দেহ ও মনকে শান্তি দিতে যেভাবে আমরা প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাই, তেমনি, এই কুম্ভমেলা একজন পুণ্যার্থীকে তার দেহ ও আত্মার পরিশুদ্ধি দেয়। যে পুণ্যার্থী একেবারে সাধারণ, গৃহী, তার জীবনযাপনও এক্কেবারে আমাদের মতো, কিন্তু সে পুণ্যলাভের জন্য সব কষ্টকে জয় করতে প্রস্তুত থাকে। ২০২৩-এ গঙ্গোত্রীতে গঙ্গাস্নান, এবং ২০২৫-এ প্রয়াগরাজের মহাকুম্ভে উপস্থিত হওয়ার অভিজ্ঞতা আমাকে বুঝতে সাহায্য করেছে, পুণ্য অর্জনের এই অদ্ভুত আকর্ষণ কখনোই সাধারণ নয়।
তবে, শুধুই কি পুণ্যলাভের উদ্দেশ্য নিয়ে এই মেলা গড়ে উঠেছে? এর চেয়ে অনেক বেশি কিছু রয়েছে। যেমন, মহাকুম্ভ বা পূর্ণকুম্ভের দিনে, আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি মানুষরা এখানে একত্রিত হয়ে সামাজিক বন্ধনও তৈরি করে। তাদের মধ্যে সমষ্টিগত সংহতি ও সহযোগিতা এক নতুন ধরনের সমাজের প্রতিষ্ঠা করে। একসাথে স্নান, একে অপরের সঙ্গে আলোচনা, পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি—এই বিষয়গুলি সত্যিই মানবতার মহা শক্তির প্রকাশ।
এ ছাড়াও, কুম্ভমেলার মাধ্যমে ছোট ছোট গ্রামের অর্থনৈতিক জীবনেও পরিবর্তন আসে। একক একটি ক্যাম্পের মাধ্যমে এলাকার মানুষের জীবিকা নির্বাহের সুযোগ হয়ে থাকে। স্নান, দান, উপাসনা এগুলি শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য নয়, এগুলি মানবজীবনকে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শেখায়। এমনকি, শীতের মধ্যে গঙ্গাস্নান বা ঠান্ডায় তীরে উঠে আসা মানুষের জীবনযাত্রার মধ্যে তাদের ন্যূনতম আধ্যাত্মিকতা ও সহ্যশক্তি প্রমাণ করে।
মহাকুম্ভে ধর্মীয় পুণ্যের অভিজ্ঞান কিন্তু কখনোই একক উদ্দেশ্য নয়। সামাজিকতা, মানবিকতার মূল্য উপলব্ধি করা, জীবনযাপনের সহজতা—এগুলো সবই কুম্ভমেলার অংশ। যখন আমরা এখানে উপস্থিত হই, তখন এক নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা ও জীবনচিন্তার সূত্র খুঁজে পাই। ২০২৫-এর মহাকুম্ভ মেলা এমন একটি জায়গা, যেখানে শুধু ধর্ম নয়, মানুষের আধ্যাত্মিকতা, সহানুভূতি, এবং সামাজিক দায়িত্ববোধের বিষয়েও নতুন পাঠ শিখতে হয়।
এই মহাকুম্ভে যে আসেন, তাঁরা শুধুমাত্র একটি নান্দনিক অভিজ্ঞতা লাভ করেন না, তাঁরা এখানে উপস্থিত হয়ে পৃথিবীর প্রতি, মানবতার প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা অনুভব করেন। এই তীর্থযাত্রা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমাদের আধ্যাত্মিক যাত্রা কখনোই একলা নয়—এটি একে অপরের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকে। কুম্ভ মেলা, স্নান, দান সব কিছুই কেবল আধ্যাত্মিক নয়, এটি আমাদের মানবিকতাও জাগ্রত করে।
মধ্যবিত্তের জন্য স্বস্তি, কিন্তু বড় শিল্পের জন্য নেই তেমন কিছু