সরস্বতী পুজোর সেই দিনগুলো
একটা সময় ছিল, যখন সরস্বতী পুজো মানেই ছিল ছেলেদের জন্য একটা ‘বিশেষ সুযোগ’। পছন্দের মেয়েটিকে দেখার, তার সঙ্গে কথা বলার, হয়তো একটু আওয়াজ দেওয়ারও! কিন্তু সময় বদলেছে। একসময় যে পুজোর সঙ্গে দূর থেকে দেখা আর সাহস করে কথা বলার একটা সম্পর্ক ছিল, সেটাই এখন বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ করার এক উৎসবে পরিণত হয়েছে।
সে সময়ের সরস্বতী পুজো
সত্তরের শেষ আর আশির শুরু। তখনও কো-এড স্কুলের প্রচলন খুব একটা হয়নি। মেয়েরা মেয়েদের স্কুলে, ছেলেরা ছেলেদের। ফলে স্বাভাবিকভাবেই একে অপরের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ ছিল সীমিত। আর তাই, সরস্বতী পুজো ছিল একটা ‘ছাড়ের দিন’। বছরের অন্য সময় যেখানে মেয়েদের সঙ্গে সহজে কথা বলা বা মেশা ‘ঠিক নয়’ বলে ধরা হত, সেই সময় এই পুজো ছিল একমাত্র সুযোগ যেখানে একটু খোলামেলা হওয়া যেত।
তখনকার ছেলেদের কাছে সরস্বতী পুজো মানে ছিল পাশের মেয়েদের স্কুলের সামনে ভিড় করা, শাড়ি পরা মেয়েদের দেখার সুযোগ নেওয়া, কিংবা কখনও কখনও ‘অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য’ করাও! সে সময়ের সমাজ মেয়েদের সঙ্গে সহজে মেশার অনুমতি দেয়নি, বরং কৌতূহল আর দূরত্বকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে, এই একদিনের জন্য সেই দূরত্ব একটু কমে আসত।
অমিতাভের যুগে ‘আওয়াজ’ দেওয়ার কালচার
সেই সময়টা ছিল অমিতাভ বচ্চনের ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’ হওয়ার যুগ। রাজেশ খন্নার পর্দার নায়িকারা তখনও অনেকটাই ‘স্বপ্নের নারী’— দূরের, অধরা। নায়কদের সঙ্গে বন্ধুত্বের জায়গায় তখনও পৌঁছতে পারেননি তাঁরা। সিনেমার বাইরের সমাজও ছিল অনেকটা তেমনই। ছেলেদের মধ্যে একটা ‘পুরুষালি দূরত্ব’ বজায় রাখার মানসিকতা তৈরি হয়েছিল। তাই সরাসরি মেলামেশা না করে, দূর থেকে দেখে মন্তব্য করাই ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার।
তখন মেয়েদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলা, সহজভাবে মিশে যাওয়া ‘সাহসের’ বিষয় ছিল। তাই সরস্বতী পুজোর দিনটাতেই সেই সাহস দেখানোর চেষ্টা হত বেশি। কেউ কেউ হয়তো সিগারেট হাতে দাঁড়িয়ে থাকার ‘কুল’ ভাব দেখাত, কেউ বা কৌতূহলী চোখে দূর থেকে দেখেই খুশি থাকত।
আমিরের আগমনে বদল
তারপর এলো নব্বইয়ের দশক। আর সেই বদলের অন্যতম বড় অংশ ছিল আমির খানের ‘জো জিতা ওহি সিকন্দর’-এর মতো সিনেমাগুলো। এই সিনেমাগুলোর মধ্যে দিয়ে ছেলেমেয়েদের মধ্যে বন্ধুত্বের ধারণা জনপ্রিয় হতে শুরু করল। কো-এড স্কুলের প্রচলন বাড়ল। ছেলে-মেয়েরা একসঙ্গে ক্লাস করতে লাগল, চকোলেট ভাগ করে খেতে লাগল, একসঙ্গে গ্রুপ স্টাডি করতে লাগল। ফলে, মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার জন্য সরস্বতী পুজোর অপেক্ষা করার দরকার আর থাকল না!
এখনকার ছেলেরা সহজেই মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে, বন্ধুত্ব করে। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সরস্বতী পুজোর দিন নতুন করে পরিচিত হওয়ার দরকার পড়ে না। এখন তারা পুজোর দিনে বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ করে, ছবি তোলে, খাওয়াদাওয়া করে, আড্ডা দেয়।
এখনকার সরস্বতী পুজো: প্রেম না বন্ধুত্বের দিন?
এখনকার পুজো অনেকটাই বদলে গেছে। ছেলেরা এখনো মেয়েদের স্কুলের সামনে দাঁড়ায় কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু সেটা আর আগের মতো ‘একমাত্র সুযোগ’ নয়। এখন প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করতে বা মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে সরস্বতী পুজোর জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। বরং এই দিনটা এখন হয়ে উঠেছে একসঙ্গে আনন্দ করার, দলবেঁধে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর।
তবে একটা দিক এখনো এক রকম রয়ে গেছে— এই পুজোয় আনন্দের অংশ সবচেয়ে বেশি স্কুলপড়ুয়াদেরই। স্কুলের গণ্ডির মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গেও একটা অন্যরকম সম্পর্ক তৈরি হয় এই দিনে। ক্লাসঘরের গাম্ভীর্যের বেড়া ভেঙে, একসঙ্গে হাসিঠাট্টা করার সুযোগ মেলে।
ভ্যালেন্টাইন্স ডে বনাম সরস্বতী পুজো
আগে সরস্বতী পুজো ছিল ছেলেদের কাছে ‘মেয়েদের দেখার’ একটা দিন। আর এখন? এখন ছেলেমেয়েরা একসঙ্গেই দিনটা কাটায়। অনেকটা বিদেশের ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’-র মতো, যেখানে প্রেমিক-প্রেমিকারা একসঙ্গে সময় কাটায়।
তবে সেটা প্রেমের জন্যই যে হয়, এমনটা নয়। এখনকার স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা সরস্বতী পুজোয় শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে ঘুরতে বেরোয়, আড্ডা দেয়, আনন্দ করে। এটা এখন প্রেমিক-প্রেমিকার একান্ত মুহূর্তের দিন না, বরং বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার একটা উৎসব।
শেষ কথা
বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে বদলেছে সরস্বতী পুজোর চেহারাও। তবু, আজও এই দিনটা বিশেষ কিছু। ছোটবেলার সেই সরল আনন্দ হয়তো এখনকার প্রজন্মের জন্য অন্যভাবে ধরা দেয়, কিন্তু তার অনুভূতি একই থাকে। যুগ পাল্টেছে, তবু সরস্বতী পুজো এখনো বাঙালি স্কুলপড়ুয়াদের জন্য এক অনন্য দিন।
মধ্যবিত্তদের জন্য সুখবর! ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ে আর কোনও আয়কর নয়