বাঘাযতীনের হেলে পড়া ফ্ল্যাট
বাঘাযতীনের চারতলা একটি ফ্ল্যাটবাড়ি বিপজ্জনকভাবে হেলে পড়ার ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে দক্ষিণ কলকাতায়। মঙ্গলবার এই বহুতলটি হেলে যাওয়ার পর বুধবার থেকেই পুরসভা ভাঙার কাজ শুরু করেছে। তবে এই বিপজ্জনক অবস্থার পেছনে লুকিয়ে আছে বহুদিনের একটি সমস্যা এবং একাধিক অনিয়মের অভিযোগ।
বাঘাযতীনের প্রোমোটারের অবিক্রীত ফ্ল্যাট এবং সোজা করার চেষ্টার রহস্য
ফ্ল্যাটবাড়িটির দু’টি ফ্ল্যাট এখনও বিক্রি হয়নি, যেগুলির মালিক প্রোমোটার সুভাষ রায়। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি সেগুলি বিক্রি করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, ফ্ল্যাটের অস্বাভাবিক হেলে থাকার কথা জানিয়ে ক্রেতাদের সতর্ক করা হতো, ফলে ফ্ল্যাট বিক্রির চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছিল। গার্ডেনরিচের সাম্প্রতিক বহুতল দুর্ঘটনার পর, প্রোমোটার আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এবং হেলে থাকা ফ্ল্যাটটি সোজা করার চেষ্টা শুরু করেন।
এই কাজের সময় ফ্ল্যাটবাড়িটিকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। বাসিন্দাদের মতে, এর উদ্দেশ্য ছিল পথচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলেও, প্রকৃতপক্ষে পুরসভার নজর এড়ানোর জন্যই এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। প্রোমোটার বাসিন্দাদের জানিয়েছিলেন, যদি পুরসভা বিষয়টি জেনে যায়, তাহলে বাড়িটিকে বিপজ্জনক ঘোষণা করে পুরোপুরি ভেঙে দেওয়া হতে পারে।
বাড়ি সোজা করার নামে চাপ এবং বাসিন্দাদের অভিযোগ
একতলায় বসবাসরত অভিজিৎ বক্সী জানান, ২০১৪ সালে তিনি এখানে থাকতে শুরু করেছিলেন। তখন বাড়িটির কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু দুই-তিন বছর পর থেকেই পিছনের দিকটা হেলে যেতে শুরু করে। প্রোমোটার একাধিকবার বিশেষজ্ঞদের এনে পরীক্ষা করান এবং দাবি করেন যে, ফ্ল্যাটবাড়ির কোনো ফাটল নেই। কিন্তু বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রোমোটার জোর করেই বাড়ি সোজা করার জন্য চুক্তিতে সই করিয়ে নেন।
বাসিন্দাদের কাছ থেকে প্রাথমিকভাবে এক লক্ষ টাকা দাবি করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা আর নেওয়া হয়নি। কিন্তু বাড়িটি সোজা করার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এ বিষয়ে কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কাউন্সিলর মিতালি বন্দ্যোপাধ্যায়।
ভাঙার কাজ এবং নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ
বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক দীপঙ্কর চক্রবর্তীর পরামর্শে বাড়ি ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে। তবে পুরো বাড়ি ধসে পড়ার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। বাসিন্দাদের অভিযোগ, অনেকের দরকারি জিনিসপত্রও বার করে নেওয়া সম্ভব হয়নি। কোন আলমারিতে কী আছে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তাঁরা।
হেলে পড়া বাড়িটির পাশের দুইটি বাড়ি থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মিতালি বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, প্রোমোটার ইচ্ছাকৃতভাবেই পুরসভার কাছ থেকে বিষয়টি লুকিয়েছিলেন। মঙ্গলবার দুপুরে ‘শুভ অ্যাপার্টমেন্ট’ নামে ওই ফ্ল্যাটবাড়ি হেলে পড়ে। সেদিন বাসিন্দারা কেউ সেখানে না থাকায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়।
প্রোমোটারের রহস্যময় অনুপস্থিতি
ঘটনার পর থেকেই প্রোমোটার সুভাষ রায় বেপাত্তা। তাঁর এলাকার বেডিংয়ের দোকানটি বুধবার সকাল থেকে বন্ধ। বাসিন্দারাও জানেন না তিনি বা তাঁর পরিবার কোথায় আছেন। মঙ্গলবার সকালে দোকান খোলা থাকলেও, ঘটনার পর থেকেই প্রোমোটারের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
বিপর্যয় মোকাবিলা ও প্রশাসনের ভূমিক
ঘটনার পরপরই এলাকায় পৌঁছান কলকাতা পুলিশের ডিসি (দক্ষিণ শহরতলি) বিদিশা কলিতা দাশগুপ্ত, যাদবপুরের বিধায়ক দেবব্রত মজুমদার এবং স্থানীয় কাউন্সিলর মিতালি। নেতাজিনগর থানায় এফআইআর দায়ের করা হয়েছে এবং প্রোমোটারের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।
বাসিন্দাদের মানসিক অবস্থা
ফ্ল্যাটবাড়ি ধসে যাওয়ার ঘটনায় বাসিন্দারা ভীষণ মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছেন। নিজেদের জিনিসপত্র উদ্ধার করার পাশাপাশি তাঁরা আশ্রয়ের সমস্যায় পড়েছেন। অনেকেই বুঝতে পারছেন না তাঁদের ভবিষ্যৎ কীভাবে চলবে।
এই ঘটনা শহরবাসীর মধ্যে আবারও ফ্ল্যাট নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। নিয়মের তোয়াক্কা না করে বাড়ি নির্মাণ এবং বিপজ্জনক অবস্থায় তা মেরামত করার এমন উদাহরণ শহরে নতুন নয়। এখন দেখার বিষয়, প্রশাসন কীভাবে এই প্রোমোটারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের কীভাবে সাহায্য করে।
টাকার পতন রুখতে আমদানি শুল্ক বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে কেন্দ্র?