ভাগ্যলক্ষ্মী
মৈনাক ভৌমিকের নতুন ছবি ‘ভাগ্যলক্ষ্মী’ একেবারে ছাপোষা মধ্যবিত্ত জীবনের গল্প নিয়ে আসলেও, এতে লুকিয়ে আছে রহস্য, রোমাঞ্চ আর এক অন্যরকম মজা। বাজেটের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, অভিনয় আর পরিচালনার মুনশিয়ানায় এই ছবি দর্শকদের মন জয় করতে সক্ষম। ঋত্বিক চক্রবর্তী ও শোলাঙ্কি রায়ের অনবদ্য অভিনয় এবং মৈনাক ভৌমিকের স্ট্রিট-স্মার্ট পরিচালনা এখানে সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়।
প্রাত্যহিক জীবনের সাধারণতা থেকে শুরু
‘ভাগ্যলক্ষ্মী’ আমাদের নিয়ে যায় সত্য আর কাবেরীর জীবনে। ধুলো জমা জানালার কাচ ভেদ করে ছড়ানো আলোয় ছাপোষা এক মধ্যবিত্ত দাম্পত্যের ছবি আঁকা হয়েছে। সত্য একটি সংবাদপত্রের অফিসে কাজ করে। তার স্বপ্ন বড় বড় খবর লেখা, কিন্তু বাস্তবে কেবল ঊর্ধ্বতনের ধাতানিই জোটে। দিনের শেষে বন্ধুদের বিলাসিতা আর নিজের জীবনের একঘেয়েমি তাকে ক্লান্ত করে। কাবেরীও গৃহিণীর পরিচিত জীবনযাপনে বন্দি। রান্নাঘর, বাসন ধোয়া আর সকালে গৃহকর্ম সহায়িকা না এলে শুরু হয় নতুন দিনের ঝামেলা।
দাম্পত্য জীবনের এই নিরসতা এবং রোমাঞ্চহীন দিনযাপনের চিত্র একদিকে পরিচিত, অন্যদিকে কষ্টদায়ক।
রোমাঞ্চের হঠাৎ আগমন
এমন নিরুত্তাপ জীবনে হঠাৎ প্রবেশ করে এক অচেনা অতিথি। এখান থেকেই গল্প নতুন মোড় নেয়। ম্যাজিক শোয়ের মতো সত্য ও কাবেরীর জীবনে দেখা দেয় রোমাঞ্চ আর দুর্ভাবনার মিশ্রণ। একের পর এক খুন, তাড়া তাড়া নোটের বান্ডিল, চাপ চাপ রক্তে মোজাইক মেঝের দাগ—সব মিলিয়ে শুরু হয় সাপ-লুডোর মতো এক উত্তেজনাপূর্ণ খেলা।
গল্পে ডার্ক হিউমারের ছোঁয়া, পুলিশের ছক, রাজনীতির জটিলতা সবই ছবিটিকে অন্য মাত্রা দেয়। মৈনাক ভৌমিক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই রহস্য ও রোমাঞ্চের জাল বুনেছেন।
অভিনয়ের অসাধারণতা
ছবির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো অভিনয়। বাজেটের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, ঋত্বিক চক্রবর্তীর অসাধারণ অভিনয় প্রতিটি দৃশ্যকে জীবন্ত করে তুলেছে। তার মুখের এক একটি অভিব্যক্তি, বিশেষ করে গাড়িতে সুটকেস তোলার সময় ছোটখাটো সূক্ষ্ম পার্থক্য, চোখ এড়ানো কঠিন। শীতের সকালে ঘাসে শিশিরবিন্দুর মতো ঋত্বিকের অভিনয় এতটাই স্নিগ্ধ যে, দর্শকের মন আরো দেখতে চায়।
শোলাঙ্কি রায়ও কম যান না। তার অভিনয়ে পাশের বাড়ির কাবেরীর ছাপ স্পষ্ট। এমন সাবলীল এবং স্বাভাবিক অভিনয় ‘ভাগ্যলক্ষ্মী’কে আরো বাস্তবসম্মত করে তোলে।
বাজেটের সীমাবদ্ধতা ঢাকার মুনশিয়ানা
ছবির বাজেট যে সীমিত, তা সহজেই বোঝা যায়। পুলিশের বড় কর্তার অফিসও সাধারণ ড্রয়িং রুমে তৈরি হয়েছে। তবুও, অভিনয় আর পরিচালনার কৌশল এই সীমাবদ্ধতাকে আড়াল করে দিয়েছে। ক্যামেরার কাজ, আলো ব্যবহার, আর সংলাপের সূক্ষ্মতা ছবিটিকে আরো সমৃদ্ধ করেছে।
মৈনাক ভৌমিক প্রমাণ করেছেন, বাজেট বড় না হলেও, একটি ছবিকে সাফল্যের পথে নিয়ে যেতে পরিচালক এবং অভিনেতাদের মুনশিয়ানা যথেষ্ট।
প্রশ্ন যা থেকেও অবান্তর
গল্পের কিছু অংশে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সত্য ও কাবেরীর কাণ্ডকারখানা কতটা বাস্তবসম্মত, বা পুলিশের ক্লু দেওয়ার জন্য গাঙ্গুলি দম্পতির আচরণ কতটা যৌক্তিক—এই প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু, মৈনাকের গল্প বলার ভঙ্গি এবং ছবির গতিশীলতা এই প্রশ্নগুলিকে সরিয়ে রেখে দর্শকদের সম্পূর্ণরূপে গল্পের জগতে নিয়ে যায়।
মৈনাকের ফেরা এবং ভাগ্যলক্ষ্মীর ভবিষ্যৎ
মৈনাক ভৌমিক এই ছবিতে তার আগের কাজের মতোই স্ট্রিট-স্মার্ট টাচ নিয়ে এসেছেন। ‘একান্তবর্তী’ বা ‘চিনি’র মতো ছবির ভিন্নতা রেখে ‘ভাগ্যলক্ষ্মী’তে তিনি আমাদের নিয়ে এসেছেন তার সেরা কাজগুলির ধাঁচে।
‘ভাগ্যলক্ষ্মী’ হয়তো বাংলা ছবির জগতে একটি নতুন পরিচয় তৈরি করবে। মৈনাকের এই ছবি তার কাছে ভাগ্য এবং লক্ষ্মী উভয়ের পথ প্রশস্ত করবেই।
শেষ কথা
বাজেট বড় নয়, কিন্তু গল্প, অভিনয় আর পরিচালনায় দক্ষতা থাকলে একটি ছবি দর্শকদের মনে জায়গা করে নিতে পারে। ‘ভাগ্যলক্ষ্মী’ তারই প্রমাণ। এটি একাধারে রহস্যময়, রোমাঞ্চকর এবং মানসিক তৃপ্তিদায়ক। যদি ভালো সিনেমা দেখতে চান, তাহলে ‘ভাগ্যলক্ষ্মী’ একবার অবশ্যই দেখুন।
‘তুমিই আমার আলো’, হৃতিককে জন্মদিনে শুভেচ্ছায় ভরালেন প্রাক্তন স্ত্রী সুজ়ান ও প্রেমিকা সাবা

