আফ্রিকায় চিনের প্রভাব বৃদ্ধি
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বেনিন এখন নতুন ভূরাজনৈতিক খেলার কেন্দ্রবিন্দুতে। গিনি উপসাগরীয় উপকূলে নৌঘাঁটি তৈরি করার পরিকল্পনা করছে চিন। বিশাল অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্যের মাধ্যমে দেশটির উপর প্রভাব বিস্তার করে সেখানকার সরকারকে নিজেদের ইচ্ছামতো পরিচালিত করতে বাধ্য করছে বেজিং। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পদক্ষেপের ফলে আটলান্টিক মহাসাগরের কৌশলগত সুবিধা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে চিন।
চিনের লক্ষ্য: গিনি উপসাগরে নৌঘাঁটি
বেনিনের অবস্থান অত্যন্ত কৌশলগত। দেশটির দক্ষিণ উপকূল আটলান্টিক মহাসাগরের গিনি উপসাগরের পাশে অবস্থিত। এখানে নৌঘাঁটি তৈরি করলে সরাসরি আটলান্টিকে প্রবেশের সুযোগ পাবে চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ)। এটি যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমি বিশ্বের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
২০২৪ সালের অগস্ট মাসে বেনিন সরকারকে বিপুল পরিমাণ সামরিক অনুদান দিয়েছে চিন। কামান, গোলাবারুদ, এবং অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে বেজিং। দীর্ঘদিন ধরে দেশটির সরকার উত্তরের ইসলামিক চরমপন্থীদের সঙ্গে লড়াই করছে। এমন সময়ে ড্রাগনের এই সামরিক সহায়তা দেশটির জন্য যথেষ্ট সময়োপযোগী ছিল বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
আফ্রিকায় চিনের ‘নিউ গ্রেট গেম’
চিনের আফ্রিকা নীতি একপ্রকার নতুন ধরনের ঔপনিবেশিকতার রূপ নিয়েছে। বিশ্লেষকরা একে ‘নিউ গ্রেট গেম’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এর আওতায় পরিকাঠামো উন্নয়নের নামে বিপুল ঋণ দিচ্ছে বেজিং। আফ্রিকার অনেক দেশ এই ঋণের ফাঁদে পড়ে তাদের গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ চিনা সংস্থার হাতে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছে।
ঋণের ফাঁদ এবং সামরিক সহযোগিতা
চিনের ঋণের মূল বৈশিষ্ট্য হল তা অত্যন্ত উচ্চ অঙ্কের এবং প্রায়শই শোধ করা অসম্ভব। এর বিনিময়ে দেশগুলিকে সড়ক, সেতু, এবং রেললাইন তৈরির মতো কাজগুলো চিনা সংস্থার মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হয়। এভাবে অর্থ ঘুরপথে নিজেদের দেশেই ফিরে আসছে।
সামরিক ক্ষেত্রে, চিন অস্ত্র এবং সরঞ্জাম সরবরাহ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলির উপর প্রভাব বাড়াচ্ছে। আফ্রিকার দেশগুলিতে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে ড্রাগন তাদের প্রভাব বিস্তার করছে।
বেনিনে চিনা প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ
বেনিনে চিনের প্রভাব নতুন নয়। দেশটির বামপন্থী নেতা ম্যাথু কেরেকৌর শাসনামলে বেজিংয়ের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঘোষিত ‘আফ্রিকা নীতি’র অধীনে চিন বেনিনে বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেয়। রেললাইন নির্মাণ, স্বাস্থ্য পরিষেবা, এবং শিক্ষাক্ষেত্রে চিনা প্রভাব ক্রমশ গভীর হয়েছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে বেনিন চিনের কাছ থেকে ৫৩ কোটি ৬০ লক্ষ ডলার ঋণ নিয়েছে। এছাড়া রেলপথ তৈরির জন্য ৪০০ কোটি ডলার ধার করেছে দেশটি। চিনা চিকিৎসক এবং প্রকৌশলীরা বেনিনের বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করে চলেছেন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
চিনের এই অগ্রগতির বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগী দেশগুলি। ভারত, ব্রাজিল, এবং তুরস্কও বেনিনে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করার চেষ্টা করছে। তবে আফ্রিকায় চিনের প্রভাব সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে ফেলা অত্যন্ত কঠিন হবে।
উপসংহার
চিনের সামরিক এবং অর্থনৈতিক নীতির মাধ্যমে আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তার করা শুধু বেনিন নয়, সমগ্র মহাদেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য পরিবর্তন করতে পারে। বেনিনে নৌঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনা সফল হলে আটলান্টিক মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমি বিশ্বের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে চিন। এই পরিস্থিতি বৈশ্বিক রাজনীতিতে নতুন দিক উন্মোচন করবে।

