কলকাতার শীতে খাওয়াদাওয়া
কলকাতার শীত মানেই আনন্দের এক বিশেষ মেজাজ। শীতের ঠাণ্ডা হাওয়ায় রাস্তার পিঠে জমে থাকা রোদ, আর তার সঙ্গে কমলালেবু ও কেকের গন্ধে ভরে ওঠে শহর। বিশেষ করে কলকাতার বাঙালির শীতকালীন অভ্যাস ও ঐতিহ্যগত খাওয়াদাওয়ার গল্প অনেকটা একটি স্মৃতি হয়ে থাকে। এই সময়টাতে শীতের আনন্দে মেতে ওঠে পাড়া-মহল্লার মানুষ, আর একে অপরকে নিয়ে বেরিয়ে আসে ভ্রমণের জন্য। কলকাতার শীতের স্বাদ, ঠান্ডা আবহাওয়া, আর একঘেয়ে কর্মব্যস্ত জীবন থেকে বেরিয়ে আসার দারুণ সুযোগ।
শীতের সাথে কলকাতার এক অদ্ভুত সম্পর্ক রয়েছে। বাঙালির খাওয়াদাওয়ার অভ্যাস বরাবরই একটু জমকালো। শীতের এই সময়ে পাড়ায় পাড়ায়, বাড়ি বাড়ি জমে ওঠে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন। অশোক মিত্র তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন বড়দিনের ছুটিতে ছোটকাকির হাতে রান্না ফুলকপি দিয়ে পারশে-ট্যাংরার ঝোল খাওয়ার কথা। সেই সময়ের খাওয়ার রীতির মধ্যে ছিল নানা রকম ঘরোয়া খাবারের স্বাদ, যা বাঙালির শীতকালীন জীবনযাত্রার একটি অপরিহার্য অংশ।
কিন্তু কলকাতার শীতে কেবল খাবারের আয়োজনই নয়, ক্রিকেটের খেলা ও ভ্রমণও রয়েছে এক বিশাল জায়গায়। প্রাচীন ইতিহাসের পাতায় উঁকি দিলে, কলকাতায় শীতকালে ক্রিকেটের ঐতিহ্যও পাওয়া যায়। ১৮০৪ সালে প্রথম ‘অফিশিয়াল’ ক্রিকেট ম্যাচের স্মৃতি আজও মিষ্টি গন্ধে মাখানো। এমনকি শীতের সকালে ময়দানে ক্রিকেট খেলা, গঙ্গার ধারে ক্রিকেট বল সুইং করা—এই দৃশ্য কলকাতার শীতের প্রিয় চিত্র হয়ে উঠেছে। বাঙালির মধ্যে ক্রিকেট খেলার আগ্রহ কোনো দিনও কমেনি, বিশেষত শীতের দিনে, যখন গরমে খেলা সম্ভব হয় না।
কলকাতার শীতের আনন্দ আরও বেড়ে যায় নানা স্থানে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগে। এক সময় বাঙালি পিকনিকের জন্য বেরিয়ে যেত মধুপুর বা অন্যান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যসম্পন্ন জায়গায়। কিন্তু এখনো কলকাতার শিশুদের ও তরুণদের জন্য চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বা নানা ইতিহাস-সংক্রান্ত স্থানে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যেস রয়েছে। শীতকালে এই ভ্রমণগুলো বিশেষ আনন্দের হয়, যেখানে একদিকে প্রকৃতির সৌন্দর্য, আর অন্যদিকে পুরনো দিনের কলকাতার স্মৃতিগুলো চিহ্নিত হয়।
কলকাতার শীতের বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য হলো কেক ও কমলালেবুর গন্ধ। বিশেষত বড়দিনে, যখন শীতের আভা পুরো শহরে বিরাজমান, কেক ও কমলালেবু যেন বাড়ির গাছপালা, পরিবার এবং বন্ধুদের মধ্যে একে অপরকে ভাগ করে নেওয়ার এক মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। শীতের সকালে যখন গরম চায়ের কাপ হাতে বাড়ির ছাদে বসে আড্ডা চলে, তখন সেই সময় কেক ও কমলালেবুর স্নিগ্ধ গন্ধ যেন সব কিছু আরো সুন্দর করে তোলে।
এক সময় কলকাতার শীত আর উৎসবের সময়, বিশেষ করে বড়দিনের ছুটিতে, ঐতিহ্যবাহী খাবারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেত বিভিন্ন অনুষ্ঠান। আশাপূর্ণা দেবী তাঁর স্মৃতিচারণে বড়দিনে কেক খাওয়ার অভ্যাসের কথা লিখে গেছেন, যেখানে ডিম দিয়ে তৈরি হৃষ্টপুষ্ট কেক খাওয়ার পরে মাথায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে ধর্মীয় নিয়ম পালন করতেন অনেকেই।
যদিও সময়ের সাথে কলকাতার শীতযাপন অনেকটাই বদলে গেছে, এখন শহরজুড়ে স্মার্টফোনের মাধ্যমে আবহাওয়া জানার চেষ্টা চলে, ‘একিউআই’-এর রিপোর্ট মেনে চলা হয়, তবুও শীতের ময়দানে ক্রিকেট খেলার দৃশ্য বা পাড়ায় পাড়া ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস হারিয়ে যায়নি। বাঙালির শীতকালীন আনন্দের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী খাওয়া-দাওয়া, ক্রিকেট খেলা এবং স্মৃতির খোঁজে বেরিয়ে যাওয়ার অভ্যাস, এই সবই কলকাতার শীতের বিশেষ চিহ্ন হয়ে রয়েছে।