আমেরিকায় জন্মালেই আর নাগরিকত্ব নয়?
নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্বভার নেওয়ার প্রথম দিনেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব আইন বিলোপের ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর এই মন্তব্য ইতিমধ্যেই আমেরিকাসহ গোটা বিশ্বে বিতর্কের ঝড় তুলেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আইন বাতিল করতে হলে ট্রাম্পকে মার্কিন সংবিধান সংশোধন করতে হবে, যা অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। তবুও, ট্রাম্পের এমন মন্তব্য অভিবাসী সম্প্রদায় এবং আমেরিকান সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব কী?
মার্কিন সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিতে জন্ম নেওয়া প্রত্যেক শিশুকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে, এমনকি তার বাবা-মা অন্য দেশের নাগরিক হলেও। এই নিয়মকে লাতিন ভাষায় বলা হয় “জুস সোলি” বা “মাটির অধিকার”। ১৮৬৮ সালে গৃহযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সংবিধানে এই সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যা তখনকার পরিস্থিতিতে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
ট্রাম্পের বক্তব্য ও বিতর্ক
ট্রাম্প সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমেরিকাই নাকি একমাত্র দেশ, যেখানে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। যদিও এই দাবি ভুল। কানাডা এবং ব্রাজিলসহ আরও কিছু দেশে একই ধরনের আইন রয়েছে। কিন্তু ট্রাম্পের মতে, এই আইনই বেআইনি অভিবাসন সমস্যার মূল কারণ। তাই তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পরপরই এই আইন বাতিলের পরিকল্পনা করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবিধান সংশোধনের মতো কঠিন প্রক্রিয়া ট্রাম্পের জন্য সহজ হবে না। প্রথমে মার্কিন কংগ্রেসের দুই কক্ষ এবং ৫০টি অঙ্গরাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন প্রয়োজন। এর পরেও আইনটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে সুপ্রিম কোর্টে। ১৮৯৮ সালের একটি মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের বৈধতাকে সমর্থন করেছিল।
অভিবাসী সম্প্রদায়ের আশঙ্কা
জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিল হলে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে অভিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর। বহু পরিবার আমেরিকায় সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য বসবাস করে, এবং এই আইন তাঁদের অস্তিত্বের ওপর সরাসরি আঘাত করবে। ট্রাম্পের এই উদ্যোগ বেআইনি অভিবাসীদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার হুমকির মতোই ভয়ঙ্কর।
ঐতিহাসিক পটভূমি
১৮৫৭ সালে আফ্রিকান ক্রীতদাস ড্রেড স্কটের করা মামলার রায় অনুযায়ী, আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কেউ আমেরিকার নাগরিক হতে পারবেন না বলে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল। কিন্তু ১৮৬৮ সালের ১৪তম সংশোধনী এই ঐতিহাসিক ভুলকে সংশোধন করে। এই আইন চালু হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিতে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেকেই নাগরিকত্বের অধিকার লাভ করেছেন।
রাজনৈতিক কৌশল?
ট্রাম্পের সমর্থকদের একাংশ মনে করছেন, এটি তাঁর রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। বেআইনি অভিবাসন নিয়ে তাঁর কঠোর মনোভাব রিপাবলিকান ভোটারদের কাছে জনপ্রিয়তা বাড়াতে সহায়ক হতে পারে। তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে গেলে ট্রাম্পকে ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে হাত মেলাতে হবে। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটি কতটা সম্ভব, তা নিয়ে সংশয় রয়ে যাচ্ছে।
ভবিষ্যৎ কী?
ট্রাম্প বলেছেন, বেআইনি অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে এবং অভিবাসী সম্প্রদায়কে শৃঙ্খলিত করার জন্য জরুরি অবস্থা জারি করার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। পাশাপাশি, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত অভিবাসীদের তালিকা তৈরি করে তাঁদের দেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে। তবে ট্রাম্পের এমন কঠোর পদক্ষেপের ফলে মার্কিন সমাজে বিভেদ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে সংবিধান সংশোধন এবং আইনি বাধা অতিক্রম করে এই আইন বাতিল করা তাঁর জন্য সহজ হবে না। তবুও, ট্রাম্পের এই হুঁশিয়ারি অভিবাসী সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং মার্কিন রাজনীতির নতুন দিক উন্মোচন করেছে।

