ট্যাব কেলেঙ্কারিতে সাইবার ক্যাফে
পশ্চিমবঙ্গের পড়ুয়াদের জন্য রাজ্য সরকারের উদ্যোগে প্রদত্ত ট্যাব কেনার টাকার কেলেঙ্কারি নিয়ে ক্রমেই জটিলতা বাড়ছে। সরকারি এই প্রকল্পের টাকাগুলি অনলাইনে চুরি করে নেওয়ার ঘটনায় মঙ্গলবার আরও চার জনকে গ্রেফতার করেছে পূর্ব বর্ধমানের পুলিশ। মালদহের বৈষ্ণবনগর এলাকা থেকে আটক হওয়া এই চার জনের সবারই নিজস্ব সাইবার ক্যাফে আছে, যেখানে বসেই তারা এই প্রতারণা কার্যক্রম পরিচালনা করত বলে অভিযোগ।
রাজ্য সরকার তরুণ শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল শিক্ষায় সাহায্যের উদ্দেশ্যে ‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পের অধীনে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠাচ্ছে, যাতে তারা ট্যাব কিনতে পারে। তবে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে অভিযোগ ওঠে, প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থীর অ্যাকাউন্টে এই টাকা পৌঁছায়নি এবং কোথাও কোথাও ভুল অ্যাকাউন্টে টাকা জমা পড়েছে। আরও অভিযোগ, হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ট্যাবের টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পূর্ব বর্ধমান জেলাতেই এমন ঘটনা বেশি ঘটেছে, যা নিয়ে রাজ্যজুড়ে তীব্র চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
তদন্তে নেমে পূর্ব বর্ধমানের পুলিশ প্রথমে বৈষ্ণবনগর থেকে হাসেম আলি নামক এক সাইবার ক্যাফে মালিককে আটক করে। এর পর উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুর থেকে আরও তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়। ধৃতরা হলেন আশারুল হোসেন, সাদিক হোসেন, ও মোবারক হোসেন। তারা সকলেই ওই প্রতারণা চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ। এদের মধ্যে আশারুল ইসলামপুরের রামগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা এবং সাদিক ও মোবারক চোপড়া থানার দাসপাড়া এলাকার বাসিন্দা।
বুধবার পুলিশ আরও চার জনকে বৈষ্ণবনগর এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে। এদের মধ্যে রকি শেখ ও পিন্টু শেখ চকসেহেরদী গ্রামের বাসিন্দা, এবং শ্রবণ সরকার ও জামাল শেখ কৃষ্ণপুর এলাকার বাসিন্দা। ধৃতরা সকলে স্থানীয় সাইবার ক্যাফের মালিক এবং তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে এই সাইবার ক্যাফে থেকেই তারা ট্যাব প্রকল্পের টাকা হ্যাক করে নিজেদের অ্যাকাউন্টে জমা করছিল।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ধৃতদের কাছ থেকে ১৫টি পেনড্রাইভ, ল্যাপটপ, কম্পিউটারের হার্ড ড্রাইভ, বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের নথি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, আরও অনেকে এই প্রতারণা চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে এবং তাদের সন্ধানেও তল্লাশি চলছে।
এই ঘটনায় জড়িত অন্যান্যদের নাম এবং তথ্য বের করার জন্য ধৃতদের রাতভর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। পুলিশ এই চক্রের আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পেরেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। অভিযুক্তরা স্বীকার করেছে, সাইবার ক্যাফেগুলি থেকে তারা শিক্ষার্থীদের অ্যাকাউন্টের তথ্য জোগাড় করত এবং এরপরেই বিভিন্ন কৌশলে টাকা সরিয়ে নিত।
এই ট্যাব কেলেঙ্কারি প্রকাশ পাওয়ার পরই পড়ুয়াদের অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী জানায়, তাদের অ্যাকাউন্টে এখনও টাকা পৌঁছায়নি এবং তারা সরকারের সাহায্যপ্রাপ্ত হওয়ার প্রতীক্ষায় রয়েছে। স্কুলের শিক্ষক এবং অভিভাবকরাও বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন, কারণ এই টাকা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা-সহায়ক যন্ত্র কেনার জন্য দেওয়া হয়েছে।
পুলিশের মতে, এই প্রতারণা চক্রের পিছনে একটি সুসংগঠিত দল কাজ করছে, যারা বিভিন্ন সাইবার ক্যাফের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করছিল। তারা হ্যাকিংয়ের কৌশল ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের ট্যাবের জন্য নির্ধারিত টাকা নিজেদের অ্যাকাউন্টে সরিয়ে নিচ্ছিল। তাই, সাইবার নিরাপত্তা আরও কঠোর করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু হয়েছে।
সরকারি এই প্রকল্পের উদ্দেশ্যই ছিল শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে রাখা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে সুবিধা দেওয়া। তবে এই ধরনের ঘটনার ফলে প্রকল্পটির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে সরকারি উদ্যোগে আঘাত আনতে পারে।
এখন দেখা যাচ্ছে, সাইবার অপরাধী চক্রগুলির জন্য এ ধরনের প্রকল্পগুলি সুযোগের দরজা খুলে দেয় এবং শিক্ষার্থীরা এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রযুক্তির যুগে সাইবার নিরাপত্তার জোরালো প্রয়োজন রয়েছে, যা এই ঘটনাটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।