ঝাড়খণ্ডে ভোটের দায়িত্ব পালনেই নতুন পরিকল্পনা
ঝাড়খণ্ডের বিধানসভা নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে, অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা পাশের রাজ্যে বসেই পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সংগঠন ও তার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অতি আস্থাভাজন হিমন্তকে বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়। এবার ঝাড়খণ্ডের নির্বাচনে বিজেপি ক্ষমতায় এলে তাঁর ভবিষ্যৎ ভূমিকা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে এক নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
লোকসভা ভোটের পর পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির পরিস্থিতি কিছুটা শঙ্কটময় অবস্থায় আছে। রাজ্যের নেতৃত্ব পরিবর্তন নিয়ে নানা প্রশ্ন ও জল্পনা চলছে। বর্তমানে রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, যার ফলে নতুন সভাপতির খোঁজ চলছে। দলের নেতারা বলছেন, এই মুহূর্তে রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের তিন স্তম্ভ—শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদার, এবং দিলীপ ঘোষের মধ্যে কিছু মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। এ কারণে দলে সংহতি কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে।
ঝাড়খণ্ড নির্বাচনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, হিমন্ত, শুভেন্দু অধিকারী, এবং শিবরাজ সিংহ চৌহানকে দায়িত্ব দিয়েছেন। নির্বাচনের প্রচার শুরু হওয়ার পর এই তিন নেতা পালাক্রমে ঝাড়খণ্ডে গেছেন এবং নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছেন। এই সুযোগে হিমন্ত পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ নিয়েছেন। তাঁর জানার আগ্রহের মূল কারণ হল, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সংগঠন কীভাবে মজবুত করা যায় এবং কেন ২০১৯ ও ২০২১ সালের নির্বাচনের মতো ভালো ফল করতে পারা গেল না।
হিমন্ত ২০১৯ সালের লোকসভা ও ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময়েও পশ্চিমবঙ্গে এসে কাজ করেছেন। তবে এবারের খোঁজ নেওয়ার ধরন এবং বিশদে জানার চেষ্টা থেকে বোঝা যায় যে, তিনি বাংলায় বিজেপির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আরও বেশি মনোযোগী। সাংগঠনিক এবং প্রশাসনিক দক্ষতার জন্যই নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহের কাছে হিমন্ত বিশেষ আস্থাভাজন। তাঁর নেতৃত্বে অসমে বিজেপির প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, যা বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে উচ্চ প্রশংসিত। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের আগে হিমন্তের এই আগ্রহে জল্পনার পারদ বাড়ছে।
বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পশ্চিমবঙ্গে কার্যকর নেতৃত্ব খুঁজে নিয়ে আসে—২০১৯ সালে কৈলাস বিজয়বর্গীয় এবং ২০২৪ সালে সুনীল বনশল ছিলেন পশ্চিমবঙ্গে দলের দায়িত্বে। তবে সুনীল বনশল ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে আশানুরূপ ফলাফল আনতে পারেননি। এমনকি বিজেপি সাতটি আসনে কম জয়লাভ করেছে। ফলে ২০২৬ সালে বনশলকে দায়িত্ব দেওয়া হবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে হিমন্তকে নতুন দায়িত্বে দেখার জল্পনা নতুন করে দানা বাঁধছে।
২০২২ সালে উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজেপি যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থন পেতে চেষ্টা করছিল, তখনও এই গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল হিমন্তকে। সেবার বাংলার তৎকালীন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়কে বিজেপির এনডিএ শিবিরের প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে আলোচনা করেই হিমন্ত স্থির করেন যে, কলকাতার বাইরে গিয়ে মমতার সঙ্গে বৈঠক করা হবে। শুভেন্দু পরামর্শ দিয়েছিলেন, তৃণমূল-বিজেপি রাজনৈতিক সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতায় সরাসরি বৈঠক করলে রাজনৈতিক সমীকরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ফলে, বৈঠকটি দার্জিলিংয়ে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ধনখড় নিজেও উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকের ফলস্বরূপ, উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৃণমূলের সাংসদরা ভোটদানে বিরত ছিলেন। যদিও তাঁরা ধনখড়ের পক্ষে ভোট দেননি, তবে বিরোধিতাও করেননি। ধারণা করা হয়, হিমন্তের কৌশলগত বুদ্ধিমত্তায় এই ফলাফল অর্জিত হয়েছিল।
ঝাড়খণ্ডে ভোট পরিচালনা করার দায়িত্ব থাকলেও, হিমন্ত যে পশ্চিমবঙ্গের জন্য মনোযোগী হয়েছেন, তা স্পষ্ট। পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির বর্তমান নেতাদের সহিত বিভিন্ন বৈঠকে তিনি জঙ্গলমহলের বিধায়কদের কাছে জানতে চেয়েছেন, কেন বিজেপির ভোট শতাংশ বৃদ্ধি পায়নি এবং কীভাবে আরও শক্তিশালী করা যায়। বঙ্গ বিজেপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নির্বাচন এবং ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে আলোচনাও চলছে।
বিজেপি আশা করছে, হিমন্ত বিশ্বশর্মার উপস্থিতি এবং তাঁর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি একটি শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। অসমে তাঁর সফল নেতৃত্ব এবং কৌশলগত বিচক্ষণতার ফলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও তাঁর উপর নতুন করে আস্থা রাখছেন, যা ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির অবস্থান শক্তিশালী করতে পারে।