এন্টালিতে বাজি ফাটানোর প্রতিবাদ
কলকাতার এন্টালি থানা এলাকার এক শান্তিপ্রিয় পরিবারের উপর বর্বর হামলার ঘটনা ঘটে। রবিবার সন্ধ্যায়, বেআইনি বাজি ফাটানোর প্রতিবাদ করায় স্থানীয় দুষ্কৃতীদের হাতে আক্রান্ত হন সায়ন কুণ্ডু নামে এক যুবক। গুরুতর জখম এই যুবকের মাথায় চারটি সেলাই পড়েছে। বাজি ফাটানোকে কেন্দ্র করে প্রথমে গালিগালাজ, এরপর মারধর, এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে পুলিশি হেনস্থারও মুখোমুখি হতে হয়। সোমবার এই ঘটনায় অভিযুক্ত দুই যুবককে গ্রেফতার করেছে এন্টালি থানার পুলিশ।
প্রতিবাদ করলেই হুমকি এবং শারীরিক আক্রমণ
সায়ন কুণ্ডু, আনন্দ পালিত রোডের বাসিন্দা, পরিবারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করছিলেন। রবিবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে এলাকার কিছু যুবক বাড়ির সামনের গলিতে বেপরোয়া ভাবে বেআইনি বাজি ফাটাতে শুরু করে। প্রতিবাদ করেন সায়নের মা, যিনি নিজেও অসুস্থ। কিন্তু তাঁর এই প্রতিবাদ যেন আগুনে ঘি ঢালে, বাজি ফাটানো বন্ধ না করে বরং আরও জোরেশোরে শুরু করে যুবকেরা। এরপর সায়ন নিজে বাইরে গিয়ে অনুরোধ করেন বাজি ফাটানো বন্ধ করতে। কিন্তু এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে স্থানীয় যুবকের দল, এবং তখনই শুরু হয় গালিগালাজ ও হুমকি।
প্রথমে তর্কাতর্কি হলেও, তা দ্রুত হাতাহাতিতে রূপ নেয়। অভিযুক্ত যুবকরা সায়নকে ঘিরে ধরে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে থাকে। তাঁর বাবা এগিয়ে আসলে তাকেও ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়। চিৎকার শুনে আশপাশের মানুষ বাইরে এলেও, কেউ সাহস করে এগিয়ে আসেনি। এরপর কোনও রকমে নিজেকে বাঁচিয়ে সায়ন বাড়িতে ফিরে যান। কিন্তু এখানেই থামেনি অত্যাচার; সায়ন যখন থানায় অভিযোগ জানাতে যাচ্ছিলেন, তখন ফের তাঁকে আটকায় ওই দুষ্কৃতীরা এবং মারধর শুরু করে। সায়নের কথায়, “ওরা রাস্তার মুখে দাঁড়িয়েছিল। আমি থানায় যাচ্ছি শুনে আবারও আমাকে আক্রমণ করে।”
পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা এবং অভিযোগ দায়েরের জটিলতা
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রথমে অভিযোগ জানাতে গেলে পুলিশ এফআইআর নেওয়ার পরিবর্তে স্থানীয়ভাবে বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেয়। যদিও সায়নের পরিবার বারংবার অভিযোগ জানায়, কিন্তু পুলিশ বিষয়টি আমলেই নিতে চায়নি। সায়নের বাবা যতীন কুণ্ডু বলেন, “প্রথমে আমাদের অভিযোগ নেয়নি পুলিশ। বরং বলল এলাকার ব্যাপার, সকলে মিলে মিটিয়ে নিতে।” শেষ পর্যন্ত অনেক বুঝিয়ে প্রথমে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়, পরে তা এফআইআরে পরিণত হয়।
এন্টালি থানা এলাকার এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আরও একটি ঘটনা ঘটেছে গল্ফ গ্রিন থানা এলাকায়। বেআইনি বাজি ফাটানোর প্রতিবাদ করায় সেখানে এক ব্যক্তিকে মারধরের অভিযোগ উঠে। তিনিও থানায় ইমেল করে অভিযোগ জানান। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁরা নিজেরাই বিষয়টি মিটিয়ে নেন।
অভিযুক্তদের গ্রেফতার এবং তদন্তের অগ্রগতি
অবশেষে, ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর এবং গণমাধ্যমে প্রতিবাদ জানানো হলে সোমবার সকালে অভিযুক্ত সুজয় রায় ও রাজু রায়কে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে আরও কেউ এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানায় পুলিশ। এক তদন্তকারী আধিকারিক বলেন, “কারা কারা এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিল, সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং অন্যান্য অভিযুক্তদেরও খোঁজ চলছে।”
বেআইনি বাজির দৌরাত্ম্য: সাধারণ মানুষের শান্তি বিঘ্নিত
শহরে দীপাবলি বা কালীপূজার সময় বেআইনি বাজি ফাটানো বন্ধের জন্য প্রতিবারই কড়া নির্দেশ থাকে। তবুও আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কিছু মানুষ নিজেদের আনন্দের জন্য অন্যের শান্তি এবং স্বাস্থ্য বিঘ্নিত করতে পিছপা হয় না। শুধু শব্দের অত্যাচারই নয়, এই ঘটনা প্রমাণ করে যে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলেই সাধারণ মানুষকে নিগ্রহের শিকার হতে হয়। বাজি ফাটানো নিষিদ্ধ হলেও তা প্রতিহত করার জন্য প্রশাসনের কোনও কার্যকরী ভূমিকা নেই বলেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আবারও প্রশ্ন উঠেছে নাগরিক সুরক্ষা এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ে। বেআইনি কাজের প্রতিবাদ করা কি ভুল? সেই প্রতিবাদ করতে গিয়ে যদি এক যুবককে লাঠির আঘাতে রক্তাক্ত হতে হয়, তবে সমাজে আইনশৃঙ্খলা কোথায়? এন্টালি এলাকার মানুষের জন্য এই ঘটনা যেমন ভীতিকর, তেমনই প্রতিবাদকারীর মনোবল নষ্ট করার উদাহরণ। এ ধরনের ঘটনা অবিলম্বে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপের দাবি রাখে।
এই ঘটনা থেকে একটি সুস্পষ্ট বার্তা উঠে আসে: নাগরিক নিরাপত্তা এবং অভিযোগ দায়েরের ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা আরও সক্রিয় এবং দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। বাজির এই উৎপাত এবং প্রতিবাদের মুখে হিংসাত্মক আক্রমণের ঘটনার সঠিক বিচার হলে তবেই এমন নির্লজ্জতা বন্ধ হবে।

