🌿 পেট-মস্তিষ্কের গোপন আলাপচারিতা: অন্ত্রের সামান্য অশান্তিতেই কেন বদলে যায় আমাদের মেজাজ?

অন্ত্রের সামান্য অশান্তিতেই কেন বদলে যায় আমাদের মেজাজ?

মানুষের মস্তিষ্ককে আমরা ভাবনার কেন্দ্র, আবেগের আধার বলেই জানি। কিন্তু জানেন কি, আমাদের পেটও কম ক্ষমতাশালী নয়? বিজ্ঞানীদের মতে, পেট এবং মস্তিষ্কের মধ্যে রয়েছে এক অদৃশ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা। এই দুই অঙ্গ নিয়ত বার্তা আদানপ্রদান করে। কোথাও যদি এই বন্ধনে চিড় ধরে, মুহূর্তে বদলে যেতে পারে মন-মেজাজ, বাড়তে পারে উদ্বেগ ও খিটখিটে ভাব। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের সাম্প্রতিক গবেষণা এই বিষয়টিকেই নতুনভাবে সামনে এনেছে।

পেটের অভ্যন্তরে থাকা অন্ত্রকে বিশেষজ্ঞরা ‘দ্বিতীয় মস্তিষ্ক’ নামে ডাকেন। কারণ, এটি শুধু খাবার হজম করে না, শরীরে কোন পুষ্টিগুণ প্রবেশ করছে, কোন ক্ষতিকর উপাদান জমছে—এই সমস্ত তথ্যও নজরে রাখে। এরপর সেই হিসেবনিকেশ মস্তিষ্কে পাঠিয়ে দেয় বিশেষ স্নায়ুর মাধ্যমে। প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসে যদি অস্বাস্থ্যকর খাবারের আধিক্য থাকে, অন্ত্রকে বাড়তি শ্রম করতে হয়। তখনই সমস্যা শুরু হয়। ক্লান্ত ও চাপগ্রস্ত অন্ত্র সঠিক বার্তা পাঠাতে পারে না, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে মেজাজে। অকারণে অস্থিরতা, মনমরা ভাব, মনঃসংযোগের ঘাটতি—সবই আসলে অন্ত্রের অস্বস্তিরই প্রতিফলন।

অন্ত্রের ভিতরে বাস করে হাজার হাজার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণু—যাকে বলা হয় গাট মাইক্রোবায়োটা। হজম শক্তি, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা, এমনকি মানসিক সুস্থতার জন্যও এই জীবাণুসমষ্টি অত্যন্ত জরুরি। এরা শরীরে নানা রাসায়নিক তৈরি করে যা মস্তিষ্কে বার্তা পাঠাতে সাহায্য করে। এই জীবাণুর ভারসাম্য নষ্ট হলেই দেখা দেয় নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যা—ফুলে যাওয়া পেট, হজমের গোলমাল, তার সঙ্গে ক্লান্তি, উদ্বেগ, রাগ—সবই একই সূত্রে বাঁধা।

গবেষকেরা জানাচ্ছেন, অন্ত্র ও মস্তিষ্কের মধ্যেকার মূল যোগাযোগের পথটি হল ভেগাস স্নায়ু। এই স্নায়ু শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলিকে সংযুক্ত করে। পেট থেকে যে বার্তা মস্তিষ্কে পৌঁছোয়, তার ৮০ শতাংশই এই স্নায়ুর মাধ্যমে যায়। অন্যদিকে, মস্তিষ্ক থেকে অন্ত্রে যে নির্দেশ পাঠানো হয়, তা মাত্র ২০ শতাংশ। অর্থাৎ মেজাজ নির্ধারণে অন্ত্রের ভূমিকা অনেকটাই বেশি।

সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয়, শরীরে উৎপন্ন সেরোটোনিনের—যাকে ‘হ্যাপি হরমোন’ বলা হয়—প্রায় ৯০ শতাংশই তৈরি হয় অন্ত্রে। সুতরাং অন্ত্রের স্বাস্থ্য খারাপ মানেই সেরোটোনিন কমে যাওয়া এবং আবেগে টানাপড়েন।

এ ছাড়া প্রদাহও একটি বড় সমস্যা। অন্ত্রে গোলমাল হলে প্রদাহজনিত রাসায়নিক রক্তে মিশে মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়। স্নায়ুতন্ত্র তার প্রভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। তখনই দেখা দেয় মানসিক ওঠাপড়া, অনিদ্রা, বিরক্তি।

❑ কী ভাবে রক্ষা করা যাবে এই পেট-মস্তিষ্কের বন্ধুত্ব?

শরীরকে সুস্থ রাখতে অন্ত্রকে ভালো রাখা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য—

• পর্যাপ্ত ফাইবার যুক্ত খাবার খেতে হবে—পালং শাক, লেটুস, ব্রকোলি, গাজর, বাঁধাকপি
• সতেজ ফল—কলা, কমলা, আঙুর, পেয়ারা
• দানাশস্য—ওটস, ডালিয়া, ব্রাউন রাইস, বার্লি
• রসুন ও অন্যান্য প্রিবায়োটিক খাবার, যা ভাল ব্যাক্টেরিয়ার বৃদ্ধি ঘটায়

এ ছাড়া জাঙ্ক ফুড, অতিরিক্ত তেল-মশলা, অনিয়মিত খাওয়া—এসবই অন্ত্র-মস্তিষ্কের ‘সম্পর্ক’-এর পক্ষে ক্ষতিকর।

মোট কথা, মন ভালো রাখতে হলে আগে পেটকে ভালো রাখতে হবে। বিজ্ঞান আজ বলছে, আমাদের আবেগ, শক্তি, মনোযোগ—সবই পেটের সঙ্গেই জড়িত। তাই স্বাস্থ্যকর খাদ্য, সঠিক অভ্যাসই পারে দুই অঙ্গের বন্ধুত্বকে শক্ত করতে।