🌼 বাবার নেপথ্য সমর্থনেই আমাদের আজকের পরিচয়—রাইমার আবেগঘন স্মৃতি

রাইমার আবেগঘন স্মৃতি!

মুনমুন সেনকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ সব সময়ই তুঙ্গে। দিদা সুচিত্রা সেনের কন্যা হওয়ায় তাঁর প্রতি কৌতূহল স্বাভাবিক। কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের বাবা, ভরত দেববর্মণকে নিয়ে মানুষের রহস্যবোধ আরও গভীর। সেন পরিবারের জামাই হয়েও তিনি কেন সব সময় নিজেকে আড়ালে রেখেছিলেন, তা আজও অনেকের প্রশ্ন। অথচ আমাদের জীবনে তাঁর ভূমিকা যে কতখানি ছিল, তা আমরা জানি সবচেয়ে বেশি।

শৈশব থেকেই দেখেছি, সংসারের প্রতিটি খুঁটিনাটি বাবার হাতেই সুচারুভাবে সামলানো হত। বাড়ির কার কোন খাবার পছন্দ, কে কীভাবে দিন কাটাতে ভালবাসে— সবই ছিল তাঁর নখদর্পণে। মা তখন ব্যস্ত স্টুডিও, শুটিং, অনুষ্ঠান আর রাজনীতির নানা কাজে; কিন্তু আমাদের দু’বোনকে কখনও এক মুহূর্তের জন্যও তিনি বুঝতে দেননি যে মা ঘরে থাকেন না। তিনি একাই ছিলেন পুরো পরিবারের শক্ত ভরসা।

বাবা ছিলেন ত্রিপুরার রাজপরিবারের সন্তান। তবুও তাঁর সাধারণত্ব, বিনয় আর মাটির গন্ধ মেশানো ব্যক্তিত্ব দেখে আমরা প্রায়ই বিস্মিত হতাম। গম্ভীর চেহারার আড়ালে ছিল অগাধ জ্ঞান, আভিজাত্যে মোড়া রুচি, আবার ঠিক তেমনই ছিল দারুণ রসবোধ। সাধারণত কম কথা বললেও, সুযোগ পেলে তিনি এমন স্বচ্ছন্দে আড্ডা দিতেন যে কেউই মুগ্ধ না হয়ে পারত না।

বাবার প্রয়াণের পর তাঁর স্মরণে ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করি আমরা। ফুলে সাজানো তাঁর ছবি ঘিরে আমরা বসেছিলাম যেমন তিনি থাকলে বসতে পছন্দ করতেন। আমাদের খুব কাছের কয়েকজন পরিচিতকেই ডাকা হয়েছিল—যাঁরা বাবাকে সত্যিই কাছ থেকে চিনতেন। পুজোর মাধ্যমে প্রার্থনা করা হয়েছিল তাঁর আত্মার শান্তির জন্য। সেই মুহূর্তে যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, আমাদের আজকের পরিচয়ের পিছনে বাবার নীরব সমর্থনই সবচেয়ে বড় শক্তি।

মা নাকি বাবাকে না পেলে অভিনয়ে আসতেই পারতেন না—এ কথা আমরা বহুবার শুনেছি। বড় হয়ে নিজেও বুঝেছি, কথাটি একেবারে সত্যি। শুধু মা নয়, আমাদের দু’বোনের ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা অপরিসীম। সিনেমা জগতের ভাল-মন্দ, অভিজ্ঞতা, সতর্কতা—সবই তিনি শোনাতেন গভীর মনোযোগে। আমরা দু’জন তাঁকে বন্ধুর মতোই পেতাম, আবার একই সঙ্গে কঠোর সমালোচকের ভূমিকাতেও দেখতাম।

অভিনয়ের প্রসঙ্গে তিনি ছিলেন নির্মম সত্যবাদী। কোনও দৃশ্যে আমরা দুর্বল হলে তা বিন্দুমাত্র আড়াল করতেন না। কখনও খারাপও লাগত, কিন্তু পরে বুঝেছি—ওই সমালোচনাই আমাদের উন্নতির পথ দেখিয়েছে।

বাবার শৌখিনতা ছিল চমকপ্রদ। বিশেষ করে সুগন্ধির প্রতি তাঁর নরম দুর্বলতা—এখনও আমাদের মনে জ্বলজ্বল করে। আলমারিতে সারি সারি কোলন সাজানো থাকত, প্রতিটির গন্ধই ছিল আলাদা। পোশাকেও ছিলেন অত্যন্ত পরিপাটি। কখনও রাগ করতে দেখিনি তাঁকে, কখনও জোর গলায় কথা বলেননি আমাদের সঙ্গে। শেষ মুহূর্তেও কাউকে কোনও অভিযোগ করেননি—এই শান্ততা তাঁর চরিত্রের সবচেয়ে বড় পরিচয়।

আজ বাবাকে ছাড়াই জীবন চললেও, মাঝে মাঝে মনে হয়—তিনি আছেন। কোনও অদ্ভুত ঘটনায় মনে হয়, যেন তিনি আমাদের পথ দেখাচ্ছেন, আগলে রাখছেন। শারীরিক ভাবে দূরে চলে গেলেও, তাঁর দায়িত্ববোধ, স্নেহ আর আশ্রয় আজও আমাদের প্রতিটি সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে।

আমাদের মা যেমন বাবার সহায়তায় অভিনয়ে এসেছিলেন, তেমনই আমরা দু’বোন আজ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে, তার প্রতিটি ইটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাবার নীরব হাতছানি। তাঁর আড়ালেই ছিল আমাদের আলো। তাঁর সঙ্গেই ছিল আমাদের আসল ভিত্তি।