🌍 সাহারার বুকের আংটি-রহস্য: জাবাল আরাকানুর জন্মভূমি ঘিরে বৈজ্ঞানিক ধাঁধা

সাহারার বুকের আংটি-রহস্য

উত্তর–পূর্ব আফ্রিকার বিস্তীর্ণ সাহারা মরুভূমি পৃথিবীর অন্যতম শুষ্ক অঞ্চল। সূর্যের তীব্র তাপে ফ্যাকাসে বালির ঢিবিগুলি যখন প্রায় অনন্ত প্রান্তরের মতো ছড়িয়ে থাকে, সেই নির্জন মরুপ্রান্তরেই আচমকা নজর কাড়ে একটি অদ্ভুত শিলাগঠন—জাবাল আরাকানু। পুরো কাঠামোটি যেন বিশাল পাথরের আংটির মতো বৃত্তাকারে মাথা তুলে রয়েছে। এর রূপ এতটাই নাটকীয় যে, আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র (ISS)-এর মহাকাশচারীর ক্যামেরায় ধরা পড়তেই বিশ্বজুড়ে নতুন করে কৌতূহল জাগে। প্রশ্ন ওঠে—কে বা কী তৈরি করল এমন অনন্য ভূ-রূপ? মানুষের হাত, ভিনগ্রহের প্রাণী, নাকি প্রকৃতিরই বিস্ময়?

লিবিয়ার দক্ষিণ–পূর্ব অংশে, মিশর সীমান্তের খুব কাছেই এই অদ্ভুত শিলাসমষ্টি অবস্থান। শুধু একটি নয়—প্রায় ৯০ কিলোমিটার পশ্চিমে আরও একটি একই রকম আংটি আকৃতির গঠন রয়েছে, যা বিজ্ঞানীদের আরও ভাবিয়েছে। একসময় অনেক ভূতত্ত্ববিদ মনে করতেন, উল্কাপাতের অভিঘাতেই মরুভূমিতে এমন বৃত্তাকার কাঠামো তৈরি হতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে।

বিজ্ঞানীদের মতে, এই ভূপৃষ্ঠ আসলে ম্যাগমার ক্রিয়ায় তৈরি। কোটি কোটি বছর আগে ভূগর্ভের গভীর থেকে উত্তপ্ত ম্যাগমা উপরে উঠে আসে এবং গহ্বরের চারপাশে শক্ত হয়ে শিলাস্তর তৈরি করে। এরপর নতুন করে ম্যাগমা উপরের স্তর ভেদ করে ওঠে এবং শিলাস্তরের উপর আবার আরেকটি স্তর জমে। এভাবে একাধিক স্তর জমতে জমতে আংটির মতো বিশাল শিলাগঠন তৈরি হয়। প্রধানত ব্যাসল্ট, গ্রানাইট, সায়ানাইট, ট্র্যাকাইট, ফোনোলাইট প্রভৃতি আগ্নেয় শিলা দিয়ে গঠিত এই রিং স্ট্রাকচার প্রায় ২৪ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে জানা গেছে, জাবাল আরাকানুর বয়স প্রায় ৫ কোটি বছর।

জাবাল আরাকানুর দক্ষিণ–পূর্ব দিকে অবস্থিত জাবাল আল আওয়ায়ানাতের গঠনও প্রায় একই ধরনের। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, একই ভূপ্রাকৃতিক প্রক্রিয়াতেই উভয়ের সৃষ্টি।

যে আইএসএস মহাকাশচারী ছবিটি তুলেছিলেন, তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন মরুভূমির উপর বড় কোনও ছায়া পড়েছে। পরে বুঝতে পারেন, এটি আংটির মতো উঁচু ভূপৃষ্ঠ—সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৪০০ মিটার উচ্চতায়। আর আংটির শীর্ষদেশ ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮০০ মিটার উঁচু।

ছবিতে আরও একটি বিস্ময়কর তথ্য উঠে এসেছে—জাবাল আরাকানুর অভ্যন্তরে রয়েছে দুটি শুকনো নদীখাত। কিন্তু সমস্যা হল—এই অঞ্চলে বছরে মাত্র ৫–১০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এমন পরিবেশে নদীখাতের উপস্থিতি বিজ্ঞানীদের আরও বিভ্রান্ত করেছে।

সম্ভাব্য ব্যাখ্যাগুলির মধ্যে রয়েছে—

• কখনও এই অঞ্চলে জলবায়ু সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল, তখন নদী প্রবাহিত হতে পারত।
• সেই সময় বেদুইনদের জল সংগ্রহের গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল এ নদীখাত।
• ভূতাত্ত্বিকরা মনে করেন, মরুভূমিতে এখন যে জলহীন নদীর চিহ্ন দেখা যাচ্ছে, তা কোটি কোটি বছর আগে গঠিত।

তবে নদীখাতের সঠিক উৎপত্তি এখনও রহস্যে ঢাকা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জাবাল আরাকানু শুধু শিলার গঠনই নয়, প্রাচীন ভূ–ইতিহাসেরও গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এই আংটির মতো কাঠামো সাহারা মরুভূমির রহস্যকে আরও গভীর ও রোমাঞ্চকর করে তুলেছে।