অ্যান্টার্কটিকার তুষার-ধাঁধা: বৃহত্তম বরফ মরুভূমির গুরুত্বপূর্ণ অংশে মিলছে না বরফ!
বিশ্বের দক্ষিণ প্রান্তে বিস্তৃত পৃথিবীর বৃহত্তম তুষার মরুভূমি, অ্যান্টার্কটিকা। মাইলের পর মাইল শুধু শুভ্র বরফের সাম্রাজ্য—মানুষহীন, নীরব, অথচ রহস্যে মোড়া। বহু দশক ধরে এই মহাদেশ বিজ্ঞানীদের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু। সম্প্রতি একদল গবেষকের নতুন অনুসন্ধান সেই কৌতূহলকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে, বরং বলা ভাল—উদ্বেগও চাড়া দিয়েছে। তাঁদের দাবি, অ্যান্টার্কটিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একাধিক অঞ্চলে বরফ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কণার ঘাটতি এতটাই প্রকট যে, ভবিষ্যতে এই অভাব ভয়াবহ জলবায়ু পরিবর্তনের দিকে ঠেলে দিতে পারে দক্ষিণ গোলার্ধকে।
মেঘে বরফ তৈরির উপাদান দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে
গবেষণায় উঠে এসেছে, অ্যান্টার্কটিকার নীচের অংশে এবং দক্ষিণ সমুদ্র সংলগ্ন এলাকায় মেঘের মধ্যে বরফকণার পরিমাণ ক্রমশ কমছে। সাধারণত মেঘে বরফের স্ফটিক গঠনের জন্য দরকার আইস নিউক্লিয়েটিং পার্টিকল (INP)—যা মূলত ধূলিকণা, মাটি, আগ্নেয় ছাই বা জীবজগতের প্রোটিনসমৃদ্ধ কণার মাধ্যমে তৈরি হয়। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে এই কণা সহজেই বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসে। কিন্তু অ্যান্টার্কটিকা—যেখানে জীবজগতের উপস্থিতি অত্যন্ত কম—সেখানে এই কণাগুলির অভাব দিন দিন প্রকট হচ্ছে।
জার্মানির লেইবনিজ় ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা অ্যান্টার্কটিকার বিভিন্ন জায়গা থেকে বাতাস সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেন এবং অবাক হয়ে দেখেন দক্ষিণতম অংশ দুটি এলাকায় INP প্রায় নেই। গবেষক হেইকে ওয়েক্সের ব্যাখ্যা, “এই অঞ্চলে জৈব উপাদানের ঘাটতি এতটাই বেশি যে বরফ জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া উল্লেখযোগ্য ভাবে মন্থর হয়ে পড়েছে।”
অস্বাভাবিক মেঘই কি দক্ষিণ গোলার্ধের রক্ষাকবচ?
গবেষণায় এক চমকপ্রদ দিকও উঠে এসেছে—বরফকণা কমে যাওয়ার ফলে মেঘে জলকণার আধিক্য তৈরি হয়, যা সূর্যের আলোকে মহাকাশে প্রতিফলিত করে। এই প্রতিফলনের ফলে দক্ষিণ গোলার্ধ অতিরিক্ত তাপ থেকে রক্ষা পায়। অর্থাৎ, বরফবর্জিত অ্যান্টার্কটিকার এই মেঘই কার্যত দক্ষিণ গোলার্ধের ঢাল!
কিন্তু সমস্যা হল—বিশ্ব উষ্ণায়ন।
তাপমাত্রা বাড়লে মেঘের ভৌতগঠন বদলে যেতে পারে। গবেষক সিলভিয়া হেনিং এর ভাষায়, “উষ্ণায়নের ফলে INP বাড়তে পারে, কারণ গলিত হিমবাহ জৈব পদার্থকে ভূমিতে এনে ফেলবে। ফলে মেঘে বরফের ঘনত্ব বাড়বে। আর যদি এমন হয়, তবে সূর্যালোক প্রতিফলিত হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে দক্ষিণ গোলার্ধ ভয়াবহ তাপমাত্রার মুখোমুখি হবে।”
আগামী দিনের ঝুঁকি—এখনই কেন সতর্ক হওয়া জরুরি?
বিজ্ঞানীদের মতে, এই পরিবর্তনগুলো আপাতত বড় বিপদ ডেকে আনছে না। কিন্তু পৃথিবী দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে। সামান্য পরিবর্তনও অ্যান্টার্কটিকার শীতল পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। বরফ না থাকলে সমুদ্রস্তর, জলবায়ুর সার্বিক নিয়ম, এমনকি দক্ষিণ গোলার্ধের তাপবন্টন ব্যবস্থাও বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে।
যে কারণে গবেষকেরা জোর দিচ্ছেন—অ্যান্টার্কটিকায় আরও বিস্তৃত ও নিয়মিত বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের উপর। কারণ যত দ্রুত এই বরফ মরুভূমির অস্বাভাবিক পরিবর্তনের প্রকৃতি বোঝা যাবে, ততই সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে ভবিষ্যৎ রক্ষায়।
সারসংক্ষেপ
অ্যান্টার্কটিকা বরফের দেশ হলেও, সেই বরফের ভিত যে নড়বড়ে হয়ে উঠছে—তা নতুন গবেষণা স্পষ্ট করে দিয়েছে। মেঘে বরফ তৈরি না-হওয়া, INP-এর ঘাটতি এবং দ্রুত বাড়তে থাকা বিশ্ব উষ্ণায়ন—সব মিলিয়ে দক্ষিণ গোলার্ধের সামনে এমন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যা এখন থেকেই সতর্কতার সঙ্গে মোকাবিলা করা জরুরি।

