মানব-বিবর্তনের অজানা অধ্যায়!
ইথিয়োপিয়ার মাটির নীচে লুকিয়ে ছিল আদিম কালের এক বিস্ময়। আজ থেকে প্রায় দেড় দশক আগে, ২০০৯ সালে, পূর্ব আফ্রিকার ওই অঞ্চলে খননকাজ চলাকালীন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা হঠাৎই খুঁজে পান আটটি পায়ের হাড়। প্রথম দেখায় মনে হয়েছিল, এগুলি কোনও আদিমানব প্রজাতির হতে পারে। কিন্তু কোন প্রজাতি?—তার উত্তর এত দিন অধরাই ছিল। দীর্ঘ ১৬ বছরের গবেষণা শেষে অবশেষে বিজ্ঞানীরা জানালেন, সেই রহস্যময় হাড় মানব-বিবর্তনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ নতুন সূত্র প্রদান করেছে।
প্রাপ্ত হাড়গুলির বয়স প্রায় ৩৪ লক্ষ বছর। অর্থাৎ, আধুনিক মানুষ তো দূরের কথা, হোমো গণের কোনও প্রজাতিই তখনও পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়নি। মানুষের পূর্বপুরুষ যারা, তাদের আবির্ভাব ঘটেছিল প্রায় ২৫–৩০ লক্ষ বছর আগে। কিন্তু যে সময়ের স্তর থেকে এই পায়ের হাড় তোলা হয়েছে, সেখানে তখন ভেসে বেড়াত অতি প্রাচীন বানর জাতীয় প্রাণী—অস্ট্রালোপিথেকাস গণের সদস্যরা।
ইতিপূর্বে বিজ্ঞানীদের সাধারণ ধারণা ছিল, অস্ট্রালোপিথেকাস অ্যাফারেনসিস—অর্থাৎ বিখ্যাত ‘লুসি’-র প্রজাতি—হোমো গণের অন্যতম পূর্বপুরুষ। বহু গবেষণা সেই তত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তাই প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, ইথিয়োপিয়ার মাটি থেকে পাওয়া হাড় সম্ভবত অ্যাফারেনসিসদেরই। কিন্তু বিশদ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, গড়ন, আয়তন ও হাড়ের বাঁক—কোনওটাই লুসির প্রজাতির সঙ্গে মেলে না।
এই হাড়গুলি উদ্ধার করেছিলেন জীবাশ্মবিদ ইয়োহানেস হাইলে-সেলাসির নেতৃত্বাধীন অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির দল। ২০১২ সালে তারা প্রাথমিক রিপোর্ট প্রকাশ করেন। কিন্তু মাপকাঠির অভাবে হাড়গুলিকে আলাদা প্রজাতি ঘোষণা করা সম্ভব হয়নি—কারণ শুধুমাত্র ঘাড়ের নীচের হাড়ের ভিত্তিতে কোনও প্রজাতি চিহ্নিত করাকে প্রত্নতত্ত্বে গ্রহণযোগ্য বলা হয় না।
পরবর্তী সময়ে একই এলাকায় দাঁতের বেশ কিছু জীবাশ্ম পাওয়া যায়। কিন্তু সেগুলি এবং পায়ের হাড় একই স্তরের কি না—এই নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। পরবর্তীতে দাঁতের আকৃতি ও রাসায়নিক গঠন বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা ঘোষণা করেন নতুন এক প্রজাতির নাম—অস্ট্রালোপিথেকাস ডেইরিমে়ডা। বহু বছর ধরে সন্দেহ রয়ে গেলেও এখন আরও কিছু নতুন জীবাশ্ম হাতে আসায় বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত—২০০৯ সালে পাওয়া পায়ের হাড় আসলে ডেইরিমে়ডা প্রজাতিরই।
গবেষণার সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক—এই প্রজাতির পায়ের বুড়ো আঙুল ছিল উল্টো দিকমুখী, অর্থাৎ গাছের ডালে আঁকড়ে ধরার উপযোগী। এরা যেমন চমৎকার ভাবে গাছে উঠত, তেমনই হাঁটতও দুই পায়ে। অন্যদিকে লুসির প্রজাতির পায়ের গঠন ছিল পুরোপুরি ভূ-পদচারণ উপযোগী। অর্থাৎ, একই সময় একই অঞ্চলে দুটি ভিন্ন বিবর্তনধারার প্রাণী বাস করত—একদল বনামুখী, অন্যদল বেশি স্থলনির্ভর।
খাদ্যাভ্যাসেও মিলল বড় পার্থক্য। দাঁতের ক্ষয় ও গঠনের বিশ্লেষণে দেখা যায়, অ্যাফারেনসিস খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করত গাছের ফল, গুল্ম ও ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ—একটি বিস্তৃত খাদ্যতালিকা। কিন্তু ডেইরিমে়ডা নির্ভর করত মূলত ফল, পাতা ও বাদামের উপর। অর্থাৎ, খাদ্যের ক্ষেত্রে দুই প্রজাতির মধ্যে কোনও প্রতিযোগিতা ছিল না। একই পরিবেশে থেকে ভিন্ন ভিন্নভাবে সম্পদ ব্যবহার করত তারা—যা বিবর্তনের বহুমুখী পথচলার ইঙ্গিত দেয়।
এই নতুন আবিষ্কার স্পষ্ট করে দিচ্ছে—মানব বিবর্তন কোনও সরলরৈখিক যাত্রা নয়, বরং এক বহুধারাযুক্ত জটিল ইতিহাস। ডেইরিমে়ডা এবং অ্যাফারেনসিস পাশাপাশি সহাবস্থান করলেও ভিন্ন পথে অভিযোজন ঘটাচ্ছিল। গবেষকেরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে আরও জীবাশ্ম মিললে হয়তো এই রহস্যময় পথচলার আরও বহু অজানা অধ্যায় সামনে আসবে।

