হাসিনা-পরবর্তী বদলে যাওয়া সমীকরণ
বাংলাদেশের বাজারে চালের দাম লাগামছাড়া। সাধারণ মানুষ যখন ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধিতে বিপর্যস্ত, তখন দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে নেমেছে সে দেশের অন্তর্বর্তী সরকার। বাজারে সরবরাহ বাড়াতে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই চাল আমদানির জন্য একাধিক নতুন দরপত্র আহ্বান করেছে। ঠিক এই সময়েই পাকিস্তানের পদক্ষেপে নজর পুরো দক্ষিণ এশিয়ার। ইসলামাবাদ এক লক্ষ টন চাল কেনার দরপত্র ডেকেছে, যার মূল লক্ষ্য— বাংলাদেশে চাল রফতানি।
একে যেমন বাংলাদেশের বাজারে চাপ কমাতে সাহায্য করবে, তেমনই হাসিনা-পরবর্তী জমানায় পাকিস্তান-ঢাকা বাণিজ্যিক সম্পর্ক যে আরও উষ্ণ হচ্ছে, সেই ইঙ্গিতও স্পষ্ট।
🔶 পাকিস্তানের নজিরবিহীন উদ্যোগ— এক লক্ষ টন চাল কেনার দরপত্র
পাকিস্তানের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অফ পাকিস্তান গত বৃহস্পতিবার ঘোষণা করেছে— তারা এক লক্ষ টন লম্বা দানার সাদা চাল কিনবে। এই চাল মূলত প্যাকেটে ভরে করাচি বন্দর থেকে বাংলাদেশে পাঠানো হবে।
যদিও দরপত্রে ইঙ্গিত রয়েছে, চালের একাংশ ইউরোপীয় দেশগুলিতেও রফতানি হতে পারে। তবুও প্রধান লক্ষ্য বাংলাদেশই।
দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন আগামী শুক্রবার।
বাংলাদেশের সঙ্গে যে পাকিস্তানের সরাসরি বাণিজ্য ফের চাঙ্গা হচ্ছে, এবং রাজনৈতিক পালাবদলের পরে সম্পর্ককে নতুন রূপ দিতে চাইছে ইসলামাবাদ— এই উদ্যোগ সেই পরিবর্তনেরই প্রতিফলন।
🔶 কেন এত চাল আমদানি করছে বাংলাদেশ?
বাংলাদেশের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সাম্প্রতিক তথ্য বলছে—
গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় এ বছরের অক্টোবরেই সব ধরনের চালের দর বেড়েছে।
ঢাকায় চালের দাম (২০২৫ সালের অক্টোবর):
- মোটা চাল: ৫২.৪৩ টাকা/কেজি
- মাঝারি দানা: ৬২.৪৩ টাকা/কেজি
- সরু দানা: ৭৭.১০ টাকা/কেজি
ট্রেডিং কর্পোরেশন অফ বাংলাদেশের মতে, ঢাকায় এই দাম আরও বেশি— বিশেষ করে ২০ নভেম্বরের তথ্য অনুযায়ী।
মূলত সরবরাহ কম, চাহিদা বেশি— ফলে সরকারকে বাধ্য হয়ে আন্তর্জাতিক বাজারের দিকেই তাকাতে হয়েছে।
🔶 হাসিনা জমানায় সম্পর্ক ছিল ঠান্ডা— এখন বদলে যাওয়া পরিস্থিতি
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়টায় পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি বাণিজ্য কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রাজনৈতিক টানাপড়েন, ঐতিহাসিক আক্রোশ এবং রাজনীতিক স্বার্থের কারণে দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল।
কিন্তু হাসিনার পতনের পর এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে আবার শুরু হয় দু’দেশের সরাসরি বাণিজ্য।
তখন থেকেই পাকিস্তান থেকে প্রায় ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করেছে বাংলাদেশ।
এ বার শাহবাজ় শরিফের সরকার সেই পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ করে ভারতীয় উপমহাদেশের বাজারে নতুন সমীকরণ তৈরি করল।
🔶 বাংলাদেশকে বাড়তি রফতানি— পাকিস্তানের লক্ষ্য কী?
বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানের এই পদক্ষেপের পেছনে রয়েছে কয়েকটি কারণ—
✔ ১. বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করা
হাসিনার পতনের পরে ইসলামাবাদ চাইছে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে স্বাভাবিক ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে।
✔ ২. রফতানি বাজার বৃদ্ধি
নিজেদের ঘরোয়া অর্থনীতির চাপ কমাতে পাকিস্তান চাইছে দক্ষিণ এশিয়ার নতুন বাজারে ঢুকতে।
✔ ৩. ইমেজ তৈরি ও স্থিতিশীলতা
খাদ্যসঙ্কট মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সহায়তা করে আন্তর্জাতিক মহলে প্রভাব বাড়াতে চাইছে পাকিস্তান।
🔶 কী ধরনের চাল রফতানি হবে?
পাকিস্তান যে চাল কিনছে তা মূলত—
- লম্বা দানার সাদা চাল (লং-গ্রেন হোয়াইট রাইস)
- উচ্চমানের
- প্যাকেটজাত করে রফতানি করা হবে
- করাচি বন্দর থেকে জাহাজে পাঠানো হবে
এই চাল বাংলাদেশে বিক্রি হলে বাজারের উপর চাপ কিছুটা কমবে বলে মনে করছে ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকার।
🔶 শেষ কথা
বাংলাদেশের চালের দাম যখন লাগাতার বেড়ে চলছে, তখন পাকিস্তান থেকে চাল রফতানির উদ্যোগ ঢাকার জন্য স্বস্তি এনে দিতে পারে। একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক মানচিত্রেও দুই দেশের সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে।

