হাকিমপুরে নামহীন মানবস্রোত!
হাকিমপুরের সীমান্ত অঞ্চলে দিন দিন বাড়ছে এক অদ্ভুত মানবস্রোত। নামহীন, পরিচয়হীন, রাষ্ট্রহীন মানুষেরা কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে ফিরে যেতে চাইছেন বাংলাদেশে। অথচ তাঁদের অপেক্ষার সময় কাটছে খোলা আকাশের নীচে, অনিশ্চয়তার মাঝে। থানায় তাঁদের রাখার জায়গা নেই, নেই সঠিক খাবারের ব্যবস্থাও। ফলে সীমান্ত ঘিরে তৈরি হয়েছে মানবিক সংকটের এক জটিল চিত্র।
বিএসএফ চেকপোস্টের সামনে দিন-রাত বসে থাকছেন শত শত মানুষ। বহু জন স্বীকার করছেন— তাঁরা অবৈধ ভাবে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন, এখন ফিরতে চান নিজের দেশে। কিন্তু কেন তাঁদের কেউ আটকে রাখছে, আর কাকে ফেরত পাঠাতে দিচ্ছে— তার কোনও স্পষ্ট উত্তর মিলছে না। ‘এসআইআর’-এর প্রসঙ্গ উঠতেই বিএসএফ-র এক আধিকারিক সতর্ক হয়ে বলেন, “রাজনীতির সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। আমরা কেবল নির্দেশ পালন করি।” সেই নির্দেশ আসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকেই— ইঙ্গিতটি বুঝিয়ে দিয়েও তিনি আর বেশি কিছু বলতে চাননি।
এই ভিড়ের প্রথম দু’দিন ৯৫ জনকে আটক করেছিল বিএসএফ, পরে তাঁদের তুলে দিয়েছিল স্বরূপনগর থানায়। কিন্তু একসঙ্গে এত জনকে রাখার পরিকাঠামো যে নেই, তা স্পষ্টই জানিয়ে দেয় পুলিশ। থানার অতিরিক্ত ভিড়, খাওয়া-দাওয়ার বিশাল ব্যয়— সব মিলিয়ে শুরু হয় বিপত্তি। বসিরহাট আদালত ও সংশোধনাগারেও বেড়ে যায় চাপ। শেষপর্যন্ত পুলিশ মুখ ঘুরিয়ে নেয়— “আমরা এখন ওদিকে তাকাচ্ছি না,” স্বীকারোক্তি এক আধিকারিকের।
বিএসএফ অবশ্য তাকাচ্ছে সব দিকেই। কে কোথা থেকে খাবার দিচ্ছে, কে কোন দলে এসে সহায়তা করছে— সব নজরে রাখছে সীমান্তরক্ষীরা। স্থানীয় এক তৃণমূল নেতা ইমরান গাজি প্রথমে মানবিক উদ্যোগ নিয়ে খাবার বিতরণ শুরু করলেও কয়েক দিনের মধ্যে তা বন্ধ করতে হয়েছে। বিএসএফ আপত্তি জানিয়ে বলেছে— “আমরা ক্যাম্পে তিনবেলা খাওয়ার ব্যবস্থা রাখছি। বাইরে কেউ খাবার দিলে উদ্দেশ্য বুঝব কী করে?” তাদের যুক্তি— ক্যামেরার সামনে বাইরে খাবার বিতরণ করলে দায়িত্বের প্রশ্ন উঠতে পারে।
তবু ক্ষুধা তো থেমে থাকে না। তাই হাকিমপুর বাজারের কামরুল গাজির হোটেলে এখন ব্যবসা তুঙ্গে। সাইকেলে ঝোলানো বড় ব্যাগে করে তিনি পৌঁছে যান সীমান্তের অস্থায়ী শিবিরে। ডিমভাত ৪০ টাকা, মাছভাত ৫০, মাংসভাত ৬০— ছোট প্যাকেটে সাজানো খাদ্যই বাঁচিয়ে রাখছে নামহীন পরিবারগুলোকে। কামরুলের হোটেলেরও নেই কোনও নাম— যেমন নেই এই মানুষগুলোর পরিচয়।
মানুষগুলো কি অনুপ্রবেশকারী? আইনত অবৈধ? পুলিশের মতো বিএসএফ-ও চেকপোস্টের বাইরে থাকা কাউকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলতে চায় না। অথচ তাঁরা নিজেরাই জানেন— তাঁরা ভারতীয় নন। পরিচয়হীন, কাগজহীন, রাষ্ট্রহীন জীবন নিয়ে তাই তিন-চার দিন ধরে বসে আছেন আকাশ তলায়।
এদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে সীমান্তের বিভিন্ন ‘ঘাট’ দিয়ে— আরশিকারি, পদ্মবিলা, দহরকান্দা, তারালি, আমুদিয়া সহ ছ’টি গ্রামের মাঝামাঝি অংশে রাতে সীমান্ত খুলে দেওয়া হচ্ছে। ছোট ছোট দলে পারাপার করানো হচ্ছে যাতে বাংলাদেশি বাহিনীর সিসি ক্যামেরায় ভিড় চোখে না পড়ে।
অদ্ভুত এক মানবিক সংকট, যেখানে মানুষের পরিচয় হারিয়ে গেছে, রাষ্ট্র তাদের নাম কেড়ে নিয়েছে, অথচ বেঁচে থাকার লড়াই থেমে নেই। হাকিমপুরের সীমান্ত আজ সেই ভাঙা স্বপ্ন— আর একটুকরো নিরাপত্তার আশ্রয় খুঁজে ফেরার দীর্ঘ অপেক্ষা।

