সুমেরুর উপকূলে রহস্যময় প্রাণীর ভিড়, উপগ্রহচিত্রে নড়ে বসেছেন বিজ্ঞানীরা
বরফে মোড়া সুমেরুর বিস্তীর্ণ অঞ্চল যেন এক অনাবিষ্কৃত গ্রহ। যেখানে দৃষ্টি যায়, সাদা বরফের স্তর আর তীব্র শূন্যতা ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। সেই নির্জনতার মাঝেই লুকিয়ে রয়েছে সোয়্যালবার্ড— নরওয়ের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত বরফঢাকা একটি দ্বীপপুঞ্জ। মানুষের বসতি প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ সেই সোয়্যালবার্ডই এ বার বিশ্বজোড়া বিজ্ঞানীদের চাঞ্চল্যের কেন্দ্রবিন্দু।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক উপগ্রহচিত্রে দেখা গেছে, দ্বীপটির উপকূলে ভিড় জমিয়েছে অতিকায় রহস্যময় প্রাণীর দল। দূর থেকে এক নজরে মনে হয়েছিল অচেনা কোনও প্রজাতি হয়তো প্রথম ধরা দিল। বিজ্ঞানীরা দ্রুত খতিয়ে দেখেন ছবিটি। পর্যালোচনায় উঠে আসে— এরা আর কেউ নয়, বরং বিশালাকৃতি সিন্ধুঘোটক বা ওয়ালরাস।
উপগ্রহচিত্রে উদ্ঘাটিত নতুন রহস্য
উত্তর মেরুকে ঘিরে থাকা আর্কটিক বৃত্তে এমন জমায়েত এর আগে দেখা যায়নি বলে জানাচ্ছেন গবেষকেরা। নরওয়ের মূল ভূখণ্ড থেকে বহু দূরে, উত্তর মেরুর পথে অবস্থিত সোয়্যালবার্ডে এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন। ‘ওয়ালরাস ফ্রম স্পেস’ নামে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবী ও বিজ্ঞানীরা উপগ্রহচিত্র ব্যবহার করে এই প্রাণীগুলির অবস্থান ও সংখ্যা বিশ্লেষণ করছেন। এই প্রকল্পে অংশ নেওয়া সংস্থাগুলির মধ্যে রয়েছে WWF এবং British Antarctic Survey।
জলবায়ু পরিবর্তনের চাপ— বরফছাড়া হয়ে উপকূলে আশ্রয়
সিন্ধুঘোটকেরা সাধারণত বিশ্রাম ও প্রজননের জন্য ভরসা করে সমুদ্রের ভাসমান বরফ-চাঁইয়ের উপর। কিন্তু ভয়াবহ হারে গলতে থাকা বরফ তাদের বাধ্য করছে স্থলভাগে আশ্রয় নিতে। এক একটি সিন্ধুঘোটকের ওজন দুই হাজার কিলোগ্রাম পর্যন্ত হয়। শীতল পরিবেশ, বরফের স্থিতি এবং সমুদ্রের ভারসাম্য তাদের টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য। বিজ্ঞানীদের মতে, সুমেরুর তাপমাত্রা পৃথিবীর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। ফলে তাদের প্রচলিত আবাসস্থল বিলীন হয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
এ ছাড়া অতিরিক্ত ভিড়, চাপ ও সংঘর্ষের ফলে আহত হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায় এই প্রাণীদের। তাই এই অস্বাভাবিক উপকূল–জমায়েতকে পরিবেশগত বিপদের গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞেরা।
সুমেরুর পরিবেশগত ভারসাম্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
সিন্ধুঘোটকরা শুধু আকারে বিশাল বলেই বিখ্যাত নয়; আর্কটিকের খাদ্যশৃঙ্খলে এদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তারা সমুদ্রতলের জীববৈচিত্র্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে এবং অসংখ্য প্রাণীর খাদ্যচক্রে প্রভাব ফেলে। তাই এদের বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি।
সোয়্যালবার্ড— রহস্য ও বৈজ্ঞানিক গুরুত্বের কেন্দ্র
সোয়্যালবার্ড দ্বীপপুঞ্জের গুরুত্ব শুধু এর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের জন্য নয়। এখানেই আছে Global Seed Vault— ভবিষ্যতের খাদ্যসুরক্ষার জন্য পৃথিবীর ১২ লক্ষেরও বেশি শস্যবীজ সংরক্ষণাগার। সেই কারণেও সারা বছরই বৈজ্ঞানিক মহলে আলোচনার কেন্দ্রস্থল এই দ্বীপ। আর এ বার সিন্ধুঘোটকদের নতুন জমায়েত সেই আলোচনা আরও উসকে দিল।
বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
যদি এখনই জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে পদক্ষেপ না করা হয়, তাহলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে আর্কটিকের বহু প্রজাতির অস্তিত্বই অনিশ্চিত হয়ে উঠবে। সিন্ধুঘোটক তার অন্যতম।
পরিবেশগত পরিবর্তন কীভাবে প্রাণীদের আচরণ বদলে দিচ্ছে, তার বাস্তব প্রমাণ এই উপগ্রহচিত্র। আর সেই কারণেই সুমেরুর এই ‘রহস্যময় ভিড়’ শুধু কৌতূহলের বিষয় নয়— এটি পৃথিবীর ভবিষ্যৎ পরিবেশগত বিপদেরও সতর্কবার্তা।

