সিপিএম
এক সময় সিপিএম ছিল বঙ্গ রাজনীতির অন্যতম শক্তিশালী দল, যা রাজ্য রাজনীতিতে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের’ ভূমিকা পালন করত। তবে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে। সিপিএমের প্রভাব অনেকটাই কমে গেছে, এবং সেই দলটির নেতা-কর্মীরা এখন নতুন পথে হাঁটছেন। একদা সিপিএমের ‘বিদ্যামন্দিরে’ তৈরি ছাত্ররা এখন তৃণমূল এবং বিজেপির ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে’ গিয়েও তাদের নতুন পরিচিতি ও গুরুত্ব তৈরি করছেন।
গত কয়েক বছরে এমন অনেক নেতাই উঠে এসেছেন, যারা সিপিএমের অঙ্গনে বড় হয়েছেন, কিন্তু বর্তমানে তৃণমূল বা বিজেপির অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এসব নেতাদের মধ্যে অনেকেই রাজনৈতিক জীবনে নতুন জগৎ আবিষ্কার করেছেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন। এর সর্বশেষ উদাহরণ হলেন আব্দুস সাত্তার, যিনি এক সময়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন এবং বর্তমানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারে সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।
এছাড়া, শুধুমাত্র তৃণমূলই নয়, বিজেপিতেও অনেক সিপিএম নেতা যোগ দিয়েছেন এবং সেখানে নিজেদের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর মধ্যে একাধিক বামফ্রন্টের পুরনো নেতা, যারা সিপিএমে দীর্ঘ সময় কাজ করেছিলেন, এখন বিজেপির দলে গিয়ে সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন।
উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ির নেতা শঙ্কর ঘোষের উদাহরণ নেওয়া যায়। ২০২১ সালের নির্বাচনের আগে সিপিএম ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়ে শঙ্কর তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নতুন করে শুরু করেন। শঙ্করের রাজনৈতিক গুরু ছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য, যাকে তিনি হেরে যান। আজ তিনি বিজেপির বিধানসভার মুখ্য সচেতক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই পরিবর্তন অনেকের কাছে অবাক করার মতো হলেও, শঙ্কর ঘোষের মতো নেতাদের তৃণমূল বা বিজেপিতে আসা রাজনীতির এক বড় ট্রেন্ডকে নির্দেশ করছে।
তেমনি, বামফ্রন্ট সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী বঙ্কিম ঘোষ, শিলিগুড়ির তাপসী মণ্ডল, এবং কলকাতার শিশির বাজোরিয়া-এর মতো নেতারা বর্তমানে বিজেপিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। শিশির, যিনি এক সময় সিপিএমের মুখপাত্র ছিলেন, বর্তমানে বিজেপির ‘বৈদেশিক সেল’-এর দেখভাল করছেন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিষয়ক দায়িত্ব পালন করছেন।
যে প্রবণতা সিপিএম নেতাদের তৃণমূল বা বিজেপিতে যোগ দেওয়ার, তা শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়, ত্রিপুরাতেও লক্ষণীয়। ত্রিপুরায় সিপিএমের প্রাক্তন নেতা রেবতীমোহন দাস ২০১৮ সালে বিজেপিতে যোগ দেন এবং তিনি বিধানসভার স্পিকারও হন। এছাড়া, বিশ্বজিৎ দত্ত, যিনি সিপিএমের জেলা সম্পাদক ছিলেন, ২০১৮ সালের পালাবদলের পর বিজেপিতে যোগ দেন। এই সমস্ত নেতা-নেত্রীরা সিপিএমের মতো একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের মধ্যে থেকেই নিজেদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন এবং সেই অভিজ্ঞতা তারা নতুন দলে গিয়ে কাজে লাগাচ্ছেন।
তৃণমূল এবং বিজেপির শিবিরে সিপিএমের নেতাদের যোগদান এবং তাদের রাজনৈতিক গুরুত্ব বাড়ানো নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, “তৃণমূল-বিজেপি মিলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেই দেউলিয়া করেছে। যদি আদর্শবোধ থাকে, তবে কেউ ভিন্ন মতাদর্শের দলে গিয়ে গুরুত্ব পেতে পারেন না।” তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষও এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন, “সিপিএমের নৌকো থেকে তো তাদের ভোটারেরাই লাফ দিচ্ছেন, তাই নেতারাও সেই পথে হাঁটছেন।” কুণাল আরও বলেছেন, “২০১১ সালে যখন সিপিএম হারল, তখন থেকেই তাদের ক্ষয় শুরু হয়।”
এদিকে, বিজেপি সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য বলেন, “বিজেপিতে যারা আসেন, তারা সকলেই সমান গুরুত্ব পান। বিজেপি একটি পার্টি যেখানে সবাইকে সমান চোখে দেখা হয়।” তার এই বক্তব্য সিপিএম নেতাদের বিজেপিতে যোগ দেওয়ার প্রবণতাকে খানিকটা গ্রহণযোগ্যতা দেয়।
এই প্রবণতা শুধু পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং ত্রিপুরাতেও স্পষ্ট। সিপিএমের প্রাক্তন নেতারা তাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা দিয়ে তৃণমূল এবং বিজেপির মধ্যে নিজেদের গুরুত্ব তৈরি করছেন। সিপিএমের পতনের পর এসব নেতারা যেভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করছেন, তা রাজ্যের রাজনৈতিক পরিবেশে এক নতুন চিত্র সৃষ্টি করেছে।
সিপিএমের ‘বিদ্যামন্দির’ থেকে তৃণমূল এবং বিজেপির ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে’ যাওয়ার প্রবণতা রাজনীতির আঙ্গিনায় একটি বড় পরিবর্তন এনেছে। এটি শুধু দলীয় স্বার্থের জন্য নয়, বরং একটি বড় রাজনৈতিক আন্দোলনের চিত্র তুলে ধরে, যেখানে একদা শীর্ষে থাকা নেতারা এখন নতুন রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচিত।