সাইক্লোন, হারিকেন, টর্নেডো, টাইফুন
ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’র আতঙ্কে গোটা উপকূলবর্তী এলাকায় আলোচনা এখন তুঙ্গে। ঘূর্ণিঝড়, হারিকেন, টর্নেডো কিংবা টাইফুনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের নাম শুনলেই মানুষ সতর্ক হয়ে যায়। কিন্তু এসব ঝড়ের মধ্যে আসলে পার্থক্য কোথায়? ‘ডানা’ ঘিরে এখন সবাই সতর্ক, তাই এসময় সাইক্লোন, হারিকেন, টর্নেডো এবং টাইফুনের মূল পার্থক্য জানা অত্যন্ত জরুরি। চলুন, এই ঝড়গুলোর প্রকৃতি ও ফারাকগুলো একটু খতিয়ে দেখি।
সাইক্লোন কী?
সাইক্লোন হলো ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রে সৃষ্টি হওয়া এক ধরনের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়। এটি নিরক্ষীয় অঞ্চলে সৃষ্ট নিম্নচাপের কারণে উৎপন্ন হয় এবং প্রচণ্ড বেগে ঘূর্ণায়মান বাতাসের সাথে বৃষ্টি ও বজ্রপাত নিয়ে আসে। সাধারণত দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরে ঘূর্ণিঝড় দেখা যায়। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে তাপমাত্রা যখন অস্বাভাবিকভাবে বাড়ে, তখন এই ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়।
১৮৪৮ সালে ব্রিটিশ-ভারতীয় আবহাওয়াবিদ হেনরি পিডিংটন প্রথমবারের মতো ‘Cyclone’ শব্দটি ব্যবহার করেন। সেই থেকেই এই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সাইক্লোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা ঘূর্ণায়মান বাতাস ও তীব্র বৃষ্টিপাতের সাথে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত।
টর্নেডো: লোকালাইজড এক বিপর্যয়
টর্নেডো অন্য একটি ভয়াবহ ঝড়, কিন্তু এটি সাইক্লোনের মতো এত বিস্তৃত এলাকাজুড়ে নয়। টর্নেডো সাধারণত নির্দিষ্ট অঞ্চলে হিংস্রভাবে ঘূর্ণায়মান বাতাসের স্তম্ভ তৈরি করে, যা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে স্থানান্তরিত হয়। এটিকে প্রায়শই ‘টুইস্টার’ বলা হয়, কারণ এর প্রবল বেগে ঘূর্ণায়মান হাওয়া ক্ষুদ্র এলাকার উপর প্রভাব ফেলে। যদিও টর্নেডোর গতি এবং শক্তি প্রায়ই স্থানীয় দুর্যোগের মতো দেখায়, তবে এর ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা প্রচণ্ড। টর্নেডো সাধারণত উষ্ণ এবং শীতল বায়ু একত্রিত হয়ে যখন সংঘর্ষ করে, তখন এর সৃষ্টি হয়।
টাইফুন: পূর্ব এশিয়ার প্রভাবশালী ঝড়
টাইফুন হলো একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়, যা মূলত উত্তর গোলার্ধে ১০০° থেকে ১৮০° পূর্ব দ্রাঘিমার মধ্যে সৃষ্ট হয়। টাইফুন সাধারণত উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে দেখা যায় এবং এর বাতাসের গতিবেগ কমপক্ষে ১২০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। তাইফুনকে মূলত পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে দেখা যায় এবং এটি সেইসব অঞ্চলে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। তাইফুন এবং সাইক্লোনের প্রক্রিয়া প্রায় একই, কিন্তু এদের নামকরণ ভৌগোলিক কারণে আলাদা।
হারিকেন: আটলান্টিকের রাজা
হারিকেন হলো সেই ঘূর্ণিঝড়, যা মূলত উত্তর আটলান্টিক বা উত্তর-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্ট হয়। হারিকেনের প্রকৃতি এবং কার্যকারিতা সাইক্লোন এবং টাইফুনের মতোই, তবে এর নামকরণ ভৌগোলিকভাবে আলাদা। যখন আটলান্টিক অঞ্চলে এই ধরনের ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়, তখন তাকে হারিকেন বলা হয়। ১১৯ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বা তার বেশি গতিবেগে বয়ে যাওয়া ঝড়গুলোকে হারিকেন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
পার্থক্যের মূল কারণ—ভৌগোলিকতা
ঘূর্ণিঝড়, টাইফুন, টর্নেডো এবং হারিকেনের মধ্যে মূল পার্থক্য হচ্ছে তাদের ভৌগোলিক উৎপত্তি। যদিও এদের সকলেই একই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, একেক অঞ্চলে এদের নামকরণ আলাদা হয়ে থাকে।
এই ঝড়গুলো যে অঞ্চলগুলোতে সৃষ্টি হয়, তার ওপর ভিত্তি করে তাদের নাম নির্ধারিত হয়। এর ফলে, সাইক্লোন ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্টি হয়, টাইফুন উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে, আর হারিকেন উত্তর আটলান্টিক অঞ্চলে দেখা যায়।
কাজেই, ঝড়ের নামগুলো আমাদের ভৌগোলিক দিক থেকে বিভ্রান্ত করতে পারে, তবে এদের কাজ কিন্তু একই—ধ্বংসাত্মক ঝড়।