সঞ্জয় রায়ের শাস্তি
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়কে শিয়ালদহ আদালত আজীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। তবে এই রায় শুধু সঞ্জয়ের শাস্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বিচারক অনির্বাণ দাস তাঁর রায়ে পুলিশি তদন্তের খামতি এবং আরজি কর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীন ভূমিকাও তুলে ধরেছেন। আদালতের নির্দেশনামায় বিচারক বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন পুলিশের অবহেলা এবং হাসপাতালের গাফিলতির বিষয়গুলি।
পুলিশি তদন্তে খামতি: কী বললেন বিচারক?
ঘটনার এফআইআর নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া থেকেই পুলিশি গাফিলতি স্পষ্ট। বিচারকের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, টালা থানার এসআই সুব্রত চট্টোপাধ্যায় নিয়ম বহির্ভূত কাজ করেছেন। বিচারক জানান, ঘটনার দিন অর্থাৎ ২০২৪ সালের ৯ অগস্ট, সুব্রত দুপুর ৩টায় কাজে যোগ দেন। এর কিছুক্ষণ পরই এসআই চিন্ময় বিশ্বাস তাঁকে ঘটনাটি জানান। সুব্রত সেই রাতেই আরজি কর হাসপাতালে গিয়ে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন। তবে এফআইআর রুজু হয় রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে। অথচ নথিতে সময় দেওয়া হয়েছে সকাল ১০টা ১০ মিনিট, যা সম্পূর্ণ অবৈধ।
বিচারক নির্দেশনামায় উল্লেখ করেছেন, “এসআই সুব্রত নিজের কাজের খুঁটিনাটি তুলে ধরেছিলেন, যা শুনে স্তম্ভিত হতে হয়। পুলিশ কেন নির্যাতিতার পরিবারের অভিযোগ নিতে এতটা সময় নিল, সেই প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর মেলেনি।”
অভিযুক্ত সঞ্জয়ের ফোন: লালবাজারের ওসির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
ঘটনার দিনে অভিযুক্ত সঞ্জয়ের মোবাইল ফোনটি লালবাজারের উইমেন্স গ্রিভ্যান্স সেলের তৎকালীন অতিরিক্ত ওসি রূপালী মুখোপাধ্যায় থানায় রেখে দিয়েছিলেন। পরে তা অভিযুক্তকে ফেরত দেওয়া হয় এবং গ্রেফতারের সময় বাজেয়াপ্ত করা হয়। বিচারক জানান, রূপালীর যুক্তি অত্যন্ত দুর্বল ছিল। এই ঘটনায় কোনও প্রমাণ মুছে ফেলা হয়েছিল কি না, তা স্পষ্ট নয়। তবে এই পদক্ষেপ পুলিশের পদ্ধতিগত গাফিলতি প্রমাণ করে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা: দায়িত্বহীনতার অভিযোগ
বিচারক অনির্বাণ দাস আরজি কর হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়েও কড়া প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি জানান, দেহ উদ্ধারের পর সিনিয়র চিকিৎসক সুমিত রায় তপাদারই প্রথম সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, মহিলা চিকিৎসককে যৌন নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে। তিনি ঘটনাস্থল পুলিশ দিয়ে সিল করার পরামর্শ দিলেও হাসপাতালের তৎকালীন সুপার সঞ্জয় বশিষ্ঠ এবং অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ বিষয়টি এড়িয়ে যান।
বিচারক নির্দেশনামায় বলেন, “ময়নাতদন্ত না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুর কারণ নির্ধারণ করা যায় না, এটি ঠিক। কিন্তু চিকিৎসক এবং প্রশাসনিক প্রধান হওয়া সত্ত্বেও কেন এই মৃত্যুকে অস্বাভাবিক মৃত্যু হিসাবে চিহ্নিত করে পুলিশকে জানানো হল না?”
সময়ের ‘কারচুপি’ এবং আত্মহত্যার ভুল তত্ত্ব
ঘটনার দিন হাসপাতালের সহকারী সুপার সুচরিতা নির্যাতিতার পরিবারকে ফোন করে জানিয়েছিলেন যে তাঁদের মেয়ের শারীরিক অবস্থা ভাল নয়। পরে আবার ফোন করে জানান, তাঁদের মেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন সুমিত রায় তপাদার। বিচারকের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা যৌন নির্যাতন এবং হত্যার মতো গুরুতর ঘটনায় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হন।
হাসপাতালের ‘গোপন বৈঠক’
দেহ উদ্ধারের পর হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ একটি গোপন বৈঠক ডাকেন, যেখানে সাতজন উপস্থিত ছিলেন। সেই বৈঠকে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল এবং কেন তা নথিভুক্ত হয়নি, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিচারক। তিনি বলেন, “পুলিশ বা সিবিআই কেন সেই রিপোর্ট আদালতে জমা দেয়নি, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। যদিও এটি মামলার বিচারে প্রভাব ফেলেনি, তবুও তথ্য লুকানোর প্রবণতা স্পষ্ট।”
পুলিশ এবং হাসপাতালের দায়িত্বে অবহেলার প্রতিফলন
এই মামলায় সঞ্জয় রায়ের শাস্তির পাশাপাশি বিচারক পুলিশের নিয়ম বহির্ভূত কাজ এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতাকে প্রথাগত দায়িত্ব লঙ্ঘনের উদাহরণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। পুলিশের তদন্তে খামতি এবং হাসপাতালের সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতা পুরো ঘটনায় বড় ভূমিকা পালন করেছে।
বিচারক অনির্বাণ দাসের রায় শুধুমাত্র একজন অভিযুক্তের শাস্তি ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, যেখানে প্রশাসনিক গাফিলতির বিরুদ্ধে কঠোর প্রশ্ন তোলা হয়েছে।