Friday, March 21, 2025

সঞ্জয়ের ফাঁসি কেন হল না: বিচারকের রায়ের মানবিক বিশ্লেষণ

Share

সঞ্জয়ের ফাঁসি কেন হল না

শিয়ালদহ আদালতে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের এক মহিলা চিকিৎসক ও পড়ুয়ার ধর্ষণ এবং হত্যার মামলায় অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়কে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বিচারক অনির্বাণ দাস তাঁর ১৭২ পৃষ্ঠার নির্দেশনামায় উল্লেখ করেছেন, “যাবজ্জীবন হল নিয়ম, আর মৃত্যুদণ্ড হল ব্যতিক্রম।” এই রায়কে কেন্দ্র করে নানা প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই জানতে চেয়েছেন, কেন বিচারক সঞ্জয়ের অপরাধকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ হিসেবে গণ্য করেননি। এমনকি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সঞ্জয়ের ফাঁসির দাবিতে অনড়। বিচারক দাস তাঁর নির্দেশনামায় এর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন।

সাজা ঘোষণার প্রেক্ষাপট

সঞ্জয়ের অপরাধ ছিল জঘন্য এবং নৃশংস। নির্যাতিতার উপর যৌন নিপীড়ন এবং শ্বাসরোধ করে হত্যার বিবরণে বিচারক স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন অপরাধের ভয়াবহতা। তিনি বলেন, “এই অপরাধ শুধু নৃশংস নয়, এটি সমাজে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দেয়।” তবে এর পরেও তিনি সঞ্জয়কে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কেন দিলেন, সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

মৃত্যুদণ্ড: ব্যতিক্রমী শাস্তি

বিচারক দাস তাঁর রায়ে বলেছেন, “মৃত্যুদণ্ড হল ব্যতিক্রম। এটি তখনই প্রযোজ্য, যখন অপরাধকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।” তিনি উল্লেখ করেছেন যে, সঞ্জয়ের অপরাধ জঘন্য হলেও এটি সেই মানদণ্ডে পড়ে না। মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার সময় আদালতকে শুধুমাত্র অপরাধের প্রকৃতি নয়, অপরাধীর সংশোধনের সম্ভাবনাও বিবেচনা করতে হয়।

বিচারক দাস সুপ্রিম কোর্টের ১৯৮০ সালের ঐতিহাসিক রায় বচ্চন সিং বনাম পাঞ্জাব সরকার মামলার কথা উল্লেখ করেন। সেই মামলায় সুপ্রিম কোর্ট মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে কড়া নীতিমালা ঠিক করেছিল। তিনি বলেন, “মৃত্যুদণ্ড শুধুমাত্র তখনই দেওয়া উচিত, যখন সংস্কারের কোনও সুযোগ নেই।” সঞ্জয়ের ক্ষেত্রে বিচারক মনে করেন, সংশোধনের সুযোগ এখনও আছে।

অপরাধের নৃশংসতা ও সামাজিক প্রভাব

বিচারক দাস তাঁর রায়ে বলেছেন, “সঞ্জয়ের অপরাধ নৃশংস এবং জঘন্য। নির্যাতিতা এক অসহায় তরুণী ছিলেন, যিনি সঞ্জয়ের যৌন লালসার শিকার হয়েছেন। এই ধরনের অপরাধ সমাজে আতঙ্ক এবং নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ তৈরি করে।” তবে বিচারক এও উল্লেখ করেন যে, অপরাধের সামাজিক প্রতিক্রিয়া বা মানুষের আবেগ বিচারিক প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে না। আদালতকে নিরপেক্ষ থেকে তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে রায় দিতে হয়।

‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ নয় কেন?

বিচারক দাস বলেছেন, “কোনও অপরাধকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ বলে ধরা হয় তখনই, যখন তথ্যপ্রমাণ এতটাই স্পষ্ট এবং অপরাধ এতটাই ভয়ানক হয় যে, সংস্কারের কোনও অবকাশ থাকে না।” তিনি আরও বলেন, “এই ধরনের মামলায় আদালতকে প্রতিশোধের মনোভাব নিয়ে বিচার করা উচিত নয়। ‘চোখের বদলে চোখ’ বা ‘প্রাণের বদলে প্রাণ’ নীতিতে বিচার করলে ন্যায়বিচার প্রক্রিয়া মানবিকতা হারাবে।”

সাজার মানবিক দিক

বিচারক দাস মনে করিয়ে দেন যে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে অপরাধীর পুরো জীবন কারাগারে কাটানো। এটি একটি কঠোর শাস্তি, যেখানে অপরাধীকে তার কাজের জন্য প্রতিদিন অনুশোচনা করতে হবে। তিনি বলেন, “মানবাধিকার এবং বিচারিক সংস্কারের কথা মাথায় রেখে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া একটি চরম সিদ্ধান্ত, যা কেবলমাত্র সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং সংশোধনযোগ্য নয় এমন অপরাধের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।”

রায়ের প্রতিক্রিয়া

সাজা ঘোষণার পর থেকেই সঞ্জয়ের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত। নির্যাতিতার পরিবারও আদালতের এই রায়ে অসন্তুষ্ট। তাঁরা সিবিআইয়ের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। বিচারক দাস তাঁর রায়ে বলেন, “মানুষের আবেগ এবং প্রতিক্রিয়া আদালতের রায়কে প্রভাবিত করতে পারে না। আইনি নীতিমালা এবং তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই রায় ঘোষণা করা হয়।”

উপসংহার

বিচারক অনির্বাণ দাসের এই রায় মানবিকতা এবং আইনি নীতির উপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়েছে। সঞ্জয়ের অপরাধ অত্যন্ত নৃশংস হলেও, এটি ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ নয় বলে বিচারক মনে করেছেন। তাঁর রায়ে উঠে এসেছে অপরাধীর সংশোধনের সম্ভাবনার বিষয়টি। সমাজের প্রতিক্রিয়া এবং বিচারিক মানবিকতার মধ্যে ভারসাম্য রেখে এই রায় দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিচার ব্যবস্থার এক মানবিক এবং নৈতিক দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য হতে পারে।

আইএসএলে প্লে-অফের স্বপ্ন ভঙ্গ, ইস্টবেঙ্গল কোচের দুঃখপ্রকাশ

Read more

Local News