শ্রুতির যুগ ফিরে এল?
বাংলার গ্রামে একসময় সন্ধ্যার আসরে গল্প বলা ছিল এক ঐতিহ্য। হ্যাজাকবাতির আলোয় কথকঠাকুরের মুখে রাজা-রানির কাহিনি, রাক্ষস-খোক্কসের গল্প শোনার মজাই ছিল আলাদা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই আসর হারিয়ে গেল, জায়গা নিল ছাপা বই। পাঠক একা হয়ে গেল, গল্প বলার মানুষটি হারিয়ে গেল। তবু কি সত্যিই হারাল শ্রুতির সংস্কৃতি?
কালের চক্রে আবারও ফিরে এসেছে গল্প শোনার যুগ। ডিজিটাল যুগের ‘অডিয়ো স্টোরি’ যেন সেই কথকঠাকুরেরই আধুনিক রূপ। ইউটিউব, পডকাস্ট, অডিয়োবুক— সব মিলিয়ে নতুন প্রজন্মের কানে বাজছে কাহিনির সুর। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, বই পড়ার অভ্যাস কি তবে কমে যাচ্ছে? ছাপা অক্ষরের জায়গা কি নিচ্ছে শ্রুতির আনন্দ?
🎙️ ‘অডিয়ো স্টোরি’র উত্থান: কেন এত জনপ্রিয়?
আধুনিক জীবনে মানুষের হাতে সময় কম, মনোযোগও ছন্নছাড়া। ব্যস্ত জীবনে একাগ্র হয়ে বই পড়ার সময় অনেকেরই হয় না। সেখানে অডিয়ো স্টোরি গাড়ি চালানোর সময়, রান্নাঘরে বা ঘুমোনোর আগে গল্পের আসর এনে দেয়। তাতেই যেন মানুষ ফিরে পাচ্ছে গল্প শোনার সেই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য।
অডিয়ো স্টোরির জনপ্রিয়তার পেছনে কিছু কারণ স্পষ্ট—
✅ হাতের কাজ করতে করতেও গল্প শোনা যায়।
✅ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সহজেই পাওয়া যায়, তাই বহন করার ঝামেলা নেই।
✅ কাহিনি বলার শৈলী ও অভিনয়ের সংমিশ্রণ এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
✅ বই পড়তে অভ্যস্ত নয় এমন মানুষের কাছেও সাহিত্য পৌঁছে যাচ্ছে।
📚 বই পড়া বনাম গল্প শোনা: কোনটা বেশি জনপ্রিয়?
কলকাতা বইমেলায় ভিড় দেখে তো বোঝা যায় না যে বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমেছে। বরং অনেকেই বলেন, অডিয়ো স্টোরি আসলে বই পড়ার আগ্রহই বাড়িয়ে তুলছে। গল্প শুনে ভালো লাগলে, অনেকে মূল বইটি পড়ার আগ্রহ দেখান। লেখক রাজর্ষি গুপ্তর কথায়, “অডিয়ো স্টোরির মাধ্যমে অনেকেই বিশ্বসাহিত্যের মণিমুক্তোর সন্ধান পান, যা পরে বই হিসেবে সংগ্রহ করেন।”
বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় কথক মীর আফসার আলি মনে করেন, “অডিয়ো স্টোরি এক নতুন ধারার কথা বলা, যেখানে শ্রোতা কাহিনির মধ্যে নাটকীয়তা অনুভব করতে পারেন।” তাঁর ইউটিউব চ্যানেল ‘গপ্পো মীরের ঠেক’ ইতিমধ্যেই ১৪ লাখ সাবস্ক্রাইবারের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে।
মীর বলেন, “পশ্চিমের অডিয়োবুকে কেবল কাহিনি পড়া হয়, কিন্তু আমি গল্প বলার মধ্যে নাটকীয় উপস্থাপনা রাখি, যা শ্রোতাদের বেশি আকর্ষণ করে।” তাঁর মতে, “শ্রবণেন্দ্রীয় দিয়ে গল্প শোনা পাঠকের মনে কল্পনার জগৎ উন্মুক্ত করে, যা শুধু ছাপা বইতে পাওয়া যায় না।”
🎭 ক্লাসিক সাহিত্যও কি জনপ্রিয়?
অনেকে মনে করেন, নতুন প্রজন্ম কেবল থ্রিলার বা হরর গল্পেই মজেছে, কিন্তু বাস্তব চিত্রটা ভিন্ন। ক্লাসিক সাহিত্যও শ্রোতাদের কাছে যথেষ্ট জনপ্রিয়। যেমন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তারানাথ তান্ত্রিক’ অডিয়ো স্টোরির মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পরবর্তীতে সেই গল্প ছোট পুস্তিকা হিসেবেও প্রকাশিত হয়েছে, যার বিক্রিও বেশ ভালো।
সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, “পড়ার মধ্যে নির্জনতা থাকে, কিন্তু শোনার রোমাঞ্চও তার চাইতে কম কিছু নয়।” অর্থাৎ, অডিয়ো স্টোরি এবং বই পড়ার মধ্যে পার্থক্য থাকলেও, একে অপরের বিকল্প নয়। বরং তারা সমান্তরালে চলছে।
🔮 ভবিষ্যতের সাহিত্য: শ্রুতি ও পাঠ্যের যুগলবন্দি
অডিয়ো স্টোরির জনপ্রিয়তা কি ছাপা বইয়ের যুগের সমাপ্তি টানবে? না, বরং এটি সাহিত্যকে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। অডিয়ো বুকের জনপ্রিয়তা বাড়লেও ছাপা বইয়ের কাটতি কমছে না, বলছেন লেখক, প্রকাশক ও পাঠকরা।
লেখক তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বইয়ের স্থায়িত্ব অনেক বেশি। শ্রবণমাধ্যম একদিন বন্ধ হয়ে গেলেও, বই থেকে যাবে।” তাই অডিয়ো স্টোরি ও বই পড়ার যুগলবন্দি বাংলা সাহিত্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।
শেষ পর্যন্ত সাহিত্যই জেগে থাকে— কখনও কানে বাজে, কখনও চোখের পাতায় ফুটে ওঠে। শ্রবণ আর পাঠের এই যুগলবন্দি আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলবে।
সুরের রাজ্যে চুরি! প্রীতমের স্টুডিয়ো থেকে উধাও ৪০ লক্ষ টাকা