Monday, December 1, 2025

শিশুদের হেলমেট সচেতনতা: দুর্ঘটনা ও উপেক্ষার গল্প

Share

শিশুদের হেলমেট

কলকাতায় শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে অসচেতনতার উদাহরণ প্রতিনিয়ত ফুটে উঠছে। বিশেষ করে, মোটরবাইকে শিশু আরোহীদের ক্ষেত্রে হেলমেট ব্যবহার একেবারেই অনুপস্থিত। গত মঙ্গলবার সল্টলেকে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় একটি শিশুর মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, শিশুদের নিরাপত্তায় এখনও কতখানি গাফিলতি রয়ে গেছে।

সল্টলেকের হৃদয়বিদারক ঘটনা

সল্টলেকের ঘটনাটি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। স্কুল থেকে ফেরার পথে একটি শিশুর মায়ের স্কুটারে পিছনে বসা অবস্থায় দ্রুতগতির বাসের ধাক্কায় শিশুটি প্রাণ হারায়। মায়ের মাথায় হেলমেট থাকলেও শিশুটির মাথা ছিল অরক্ষিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি শিশুটির মাথায় হেলমেট থাকত, তাহলে এই দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো।

এই ঘটনা নতুন কিছু নয়। শহরের রাস্তায় এমন অনেক অভিভাবককে দেখা যায় যারা নিজেরা হেলমেট পরেন, কিন্তু সন্তানদের মাথার সুরক্ষায় হেলমেট পরানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না।

সচেতনতার অভাব ও বিধি লঙ্ঘন

দুর্ঘটনার পরও কলকাতার রাস্তায় এমন অসচেতনতার চিত্র পাল্টায়নি। পার্ক সার্কাস, যাদবপুর, শ্যামবাজার, এবং গল্ফ গ্রিনের মতো ব্যস্ত এলাকায় অভিভাবকদের মাথায় হেলমেট দেখা গেলেও শিশুদের মাথায় তা অনুপস্থিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছোটদের হেলমেটের অজুহাতে, বা অল্প দূরত্বে যাওয়ার কথা বলে দায়িত্ব এড়ানো হয়। কেউ কেউ হেলমেট ব্যবহার করলেও সেটি সঠিকভাবে বাঁধা থাকে না, যা দুর্ঘটনায় কার্যত কোনও সুরক্ষা দেয় না।

পুলিশের নজরদারির অভাব

যদিও ভারতের মোটরযান আইনে হেলমেট না পরার জন্য ১২৮ এবং ১৯৪ (সি) ধারায় মামলা রুজু করার বিধান রয়েছে, বাস্তবে এর প্রয়োগ খুবই দুর্বল। শিশুদের জন্য হেলমেটের ব্যবহার না করা হলে এক হাজার টাকা জরিমানা করার আইন থাকলেও এটি কার্যকর করার সংখ্যা খুবই কম।

পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে, অভিভাবকদের একাংশ এই ধরনের আইনি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে একত্রিত হন, যা পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে নিরুৎসাহিত করে। যদিও ট্র্যাফিক পুলিশের একাংশ দাবি করেছেন যে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করা হচ্ছে, তবে সেসব উদ্যোগের প্রভাব এখনও অনুল্লেখযোগ্য।

অভিভাবকদের মনোভাব

অভিভাবকদের অনেকেই দাবি করেন, ‘‘শিশুদের জন্য হেলমেটের সুবিধা কোথায়?’’ কিংবা ‘‘কাছের দূরত্বে যেতে হেলমেট লাগবে কেন?’’ এই ধরনের যুক্তি শুধু তাদের অসচেতনতারই প্রকাশ নয়, বরং শিশুদের নিরাপত্তা সম্পর্কে তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রমাণ।

অভিভাবকদের এই মনোভাবের পরিবর্তন জরুরি। তাদের বুঝতে হবে, রাস্তা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে এবং সামান্য অবহেলাও শিশুর জীবনের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

হেলমেটের প্রাপ্যতা নিয়ে সমস্যা

বাজারে শিশুদের উপযোগী হেলমেট সহজলভ্য নয় বলে অনেকেই অভিযোগ করেন। তবে, সচেতন অভিভাবকরা কিছু অনলাইন ও অফলাইন স্টোরে এই ধরনের হেলমেটের সন্ধান পাচ্ছেন। প্রশাসনের উচিত এই ধরনের পণ্য সহজলভ্য করার উদ্যোগ নেওয়া এবং এ বিষয়ে আরও সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

আইন প্রয়োগের বিকল্প পথ

শুধু আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ট্র্যাফিক বিভাগের সঙ্গে অভিভাবকদের সচেতন করার দায়িত্ব স্কুল ও সমাজের অন্যান্য সংস্থাগুলিরও নিতে হবে।
কলকাতা পুলিশ ইতোমধ্যেই স্কুলগুলোর সঙ্গে মিলিত হয়ে সচেতনতা প্রচার শুরু করেছে। ‘‘আপনার সন্তান হেলমেট পরুক, এটি তার জীবনের সুরক্ষা’’—এই বার্তা আরও ব্যাপকভাবে প্রচার করা প্রয়োজন।

সচেতনতার উদ্যোগ

এক সময় কলকাতা পুলিশ একটি জনপ্রিয় স্লোগান ব্যবহার করেছিল:
‘‘বাবার মাথা ভীষণ দামি, হেলমেটেতে ঢাকা। ছোট্ট মাথার নেই কোনও দাম, আমার মাথা ফাঁকা।’’

এই স্লোগানের মাধ্যমে অভিভাবকদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু এই উদ্যোগের যথেষ্ট প্রচার না হওয়ায় এর প্রভাব সীমিত থেকে গেছে। সময় এসেছে এই ধরনের উদ্যোগ পুনরায় সক্রিয় করার।

ভবিষ্যতের পথ

কলকাতার রাস্তায় শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। প্রশাসন, পুলিশ এবং অভিভাবকদের যৌথভাবে সচেতনতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।

যদি প্রতিটি অভিভাবক তাদের সন্তানদের জন্য হেলমেট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলি এই বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেন, তাহলে শহরের রাস্তায় এই ধরনের দুর্ঘটনার সংখ্যা কমানো সম্ভব।

Read more

Local News