ওয়াকফ বিল পাস!
দীর্ঘ ১৩ ঘণ্টার উত্তপ্ত বিতর্কের পর অবশেষে লোকসভায় পাস হয়ে গেল ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৫। বিলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন ২৮৮ জন সাংসদ, বিপক্ষে ছিলেন ২৩২ জন। মোট ভোট পড়েছে ৫২০টি। যদিও অধিবেশন ছিল তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ, তবে বিরোধীদের কড়া আপত্তি আর যুক্তি-পাল্টা যুক্তির মধ্যেই কেটে গেছে রাতভর আলোচনা। বৃহস্পতিবার এই বিল পেশ হবে রাজ্যসভায়।
বিতর্কের শুরু ও বিরোধীদের আপত্তি
বুধবার সংসদে বিল পেশের আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। পরে কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু বিলটি পেশ করেন। কিন্তু বিল পেশের পদ্ধতি নিয়ে প্রথম থেকেই আপত্তি তোলেন তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ সৌগত রায়। তার অভিযোগ, যৌথ সংসদীয় কমিটির (JPC) রিপোর্টে বিরোধীদের মতামতকে পাত্তা দেওয়া হয়নি।
বিরোধীরা দাবি করেন, এই বিলের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তি সংক্রান্ত নীতিতে সরকার একতরফা পরিবর্তন আনতে চাইছে, যা সংবিধান বিরোধী। কংগ্রেস, তৃণমূল, সমাজবাদী পার্টি, ডিএমকে, এনসিপি, আরজেডি সহ একাধিক দল বিলের বিরোধিতায় একজোট হয়। শিবসেনা (উদ্ধব গোষ্ঠী)-ও বিলের কিছু ধারা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
বিজেপির পাল্টা যুক্তি
বিরোধীদের সমালোচনার জবাবে কিরেন রিজিজু বলেন, “এই বিল মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে নয়, বরং ওয়াকফ সম্পত্তির সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের উন্নতির জন্য আনা হয়েছে।” তিনি জানান, ২৮৪টি প্রতিনিধি দল, ২৫টি রাজ্য এবং ওয়াকফ বোর্ডের মতামত নিয়েই এই বিল তৈরি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নাম উল্লেখ করে রিজিজু দাবি করেন, “পূর্বতন ইউপিএ সরকার সংসদ ও বিমানবন্দরের জমি ওয়াকফের হাতে তুলে দিয়েছিল, যা বর্তমান সরকার বন্ধ করেছে।”
বিরোধীদের অভিযোগ: ‘মেরুকরণের রাজনীতি’
সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ যাদব অভিযোগ করেন, বিজেপি রাজনৈতিক সুবিধার জন্য এই বিল এনেছে। তিনি বলেন, “বিজেপির নেতারা আগে ইদের উৎসবে যেতেন, এখন তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিল আনছেন। কেন?”
কংগ্রেস সাংসদ গৌরব গগৈ বলেন, “এই বিল সংবিধানকে উপেক্ষা করছে। এটি সংখ্যালঘুদের অপমান করছে এবং ভারতীয় সমাজকে বিভক্ত করতে চাইছে।”
তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় আরও একধাপ এগিয়ে বিলটিকে “অসাংবিধানিক” বলে আখ্যা দেন। তার মতে, “বিলের মাধ্যমে সরকার ওয়াকফ সম্পত্তি হস্তগত করতে চাইছে এবং মুসলিমদের অধিকার খর্ব করছে।”
এনডিএ শরিকদের সমর্থন
যদিও বিরোধীরা একজোট হয়ে বিলের বিরোধিতা করেছে, কিন্তু বিজেপি শরিক দলগুলি বিলের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। নিতীশ কুমারের জেডিইউ, চন্দ্রবাবু নাইডুর টিডিপি ও চিরাগ পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি শেষ মুহূর্তে সরকারের পাশেই দাঁড়ায়। তাদের যুক্তি, বিলটি মুসলিমদের উন্নয়ন ও নারীদের ক্ষমতায়নে সহায়ক হবে।
ওয়াকফ বোর্ড ও সম্পত্তি নিয়ে মূল বিতর্ক
এই বিলের মূল বিতর্ক ছিল ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা ও সম্পত্তি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত নিয়ম। ২০১৩ সালে ইউপিএ সরকারের আনা ওয়াকফ আইনের সমালোচনা করে বিজেপি সাংসদ তেজস্বী সূর্য বলেন, “ওই আইন ওয়াকফ বোর্ডকে এত বেশি ক্ষমতা দিয়েছিল যে, তারা যখন খুশি যে কোনো জমির মালিকানা দাবি করতে পারত। সেটি বন্ধ করতেই এই সংশোধনী।”
অন্যদিকে, মিম প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়েইসি বিজেপির বক্তব্য খারিজ করে বলেন, “২০১৩ সালের সংশোধনী যখন পাস হয়েছিল, তখন বিজেপির শীর্ষ নেতারা সংসদে ছিলেন। তাহলে তারা তখন কেন আপত্তি করেননি?” তার অভিযোগ, “মোদী সরকার মুসলিমদের জমির অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করতে চাইছে।”
শাহের কড়া বার্তা
বিতর্কের মাঝে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “কেউ অন্যের জমি দান করতে পারে না। দান করতে হলে নিজের জমি দান করতে হয়। ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে যেসব অনিয়ম হয়েছে, সরকার তা বন্ধ করতে চায়।”
তিনি আরও জানান, “ওয়াকফ বোর্ডে কোনো অমুসলিম সদস্য রাখা হবে না। বিরোধীরা অপ্রয়োজনীয় বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।”
শেষ কথা
লোকসভায় পাশ হয়ে যাওয়ার পর এখন নজর রাজ্যসভায়। সেখানে বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় বিতর্ক আরও তীব্র হতে পারে। বিরোধীরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে, তবে সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে।
এই বিল সত্যিই মুসলিমদের কল্যাণের জন্য, নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আনা হয়েছে— তা নিয়ে বিতর্ক চলতেই থাকবে। তবে আপাতত একথা স্পষ্ট, বিজেপি তার রাজনৈতিক শক্তি দেখিয়ে লোকসভায় বিল পাস করিয়ে নিয়েছে। এখন দেখার বিষয়, রাজ্যসভায় এই বিলের ভাগ্য কী হয়!
ট্রাম্পের ‘পাল্টা শুল্ক’ ঘোষণার অপেক্ষায় বিশ্ব, ভারতের চিন্তা বাড়ছে!