Sunday, November 30, 2025

রুশ আগ্রাসনে বিপর্যস্ত কিভের যুদ্ধরেখা: সৈন্যস্বল্পতা, পালানোর প্রবণতা ও ইউক্রেনের অস্তিত্বের সংকট

Share

রুশ আগ্রাসনে বিপর্যস্ত কিভের যুদ্ধরেখা!

চার বছর পূর্ণ করতে চলেছে ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অদম্য মানসিকতা দেখালেও যত দিন যাচ্ছে ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে— জনবল স্বল্পতার কারণে ক্রমশ ভেঙে পড়ছে ইউক্রেনের সামনের যুদ্ধরেখা। রুশ বাহিনীর লাগাতার আক্রমণ যেমন ইউক্রেনের সামরিক শক্তিকে দমিয়ে দিচ্ছে, তেমনই বাড়ছে ভয়, হতাশা ও পলায়নপরতার প্রবণতা। ফলে কিভের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ভিত নড়বড়ে হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন সামরিক বিশ্লেষকেরা।

গত বছরের শেষ দিকেই ইউক্রেনীয় বাহিনীর শীর্ষ কর্তারা বুঝতে পেরেছিলেন—যদি তাড়াতাড়ি সৈন্যসংকট মেটানো না যায়, তা হলে যেকোনও মুহূর্তে রণাঙ্গনের ‘ফ্রন্ট লাইন’ ভেঙে পড়তে পারে। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির কাছে এই সতর্কবার্তা পৌঁছলেও সমস্যার কোনও কার্যকর সমাধান তিনি দেখাতে পারেননি। ২০২৫ সালে এসে এই সংকট যেন আরও প্রকট রূপ নিয়েছে।

কিভের জেনারেল প্রসিকিউটরের বক্তব্য অনুযায়ী, ‘‘রাশিয়ার তীব্র আক্রমণে বহু সৈনিক মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ছেন। অনেকে রণক্ষেত্র ছেড়ে গোপনে পালানোর চেষ্টা করছেন, আবার কোথাও কোথাও পুরো পোস্ট ফাঁকা করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে।’’ সহযোদ্ধাদের মৃত্যু ও চরম ক্লান্তি ফৌজের মনোবলকে এমন জায়গায় ঠেলে দিয়েছে, যেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন।

ইউক্রেনের পার্লামেন্টের প্রতিরক্ষা কমিটির সেক্রেটারি রোমান কোসতেনকো জানিয়েছেন, গত দু’মাসে সেনা প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে পালিয়েছেন প্রতি পাঁচ জনে চার জন নতুন রিক্রুট। পাশাপাশি দেশ ছেড়ে গিয়েছেন এক লক্ষেরও বেশি যুবক-যুবতী। কেউ কেউ ঘুষ দিয়ে সীমান্ত পেরিয়েছেন, কেউ আবার চিকিৎসার অছিলায় আর কখনও ফেরেননি। ফলে নতুন বাহিনী গঠনে বিপাকে পড়েছে জ়েলেনস্কি প্রশাসন।

অন্য দিকে, যারা রণাঙ্গনে পৌঁছচ্ছেন, তাঁদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে আদেশ অমান্য করার প্রবণতা। সামরিক বিশেষজ্ঞ ওলেক্সান্ডার কোভালেনকোর মতে, ‘‘এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা অস্ত্র সংগ্রহের থেকেও কঠিন। ভবিষ্যতে জ়েলেনস্কি হয়তো ১৮ বছর বা তার কম বয়সিদেরও সেনায় নেওয়ার অনুমতি দিতে বাধ্য হতে পারেন।’’

কিন্তু পলাতক সৈনিকদের প্রতি সরকার কোনও সহানুভূতি দেখাচ্ছে না। ধরা পড়লে তাঁদের সামরিক আদালতে তোলা হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বহু ইউক্রেনীয় জওয়ান অভিযোগ করেছেন— পলায়ন রুখতে কমান্ডারেরা প্রায় অমানবিক আচরণ করছেন, এতে বাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ আরও বাড়ছে।

এপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কিছু সৈনিক জানান, রণক্ষেত্রে ‘‘শুধু রক্ত আর মৃত্যু’’ দেখার পর আর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মানসিকতা নেই তাঁদের। শত্রুপক্ষের তুলনায় নিজেদের দুর্বলতা বুঝেই অনেকে আত্মসমর্পণে আগ্রহী। তাদের দাবি, ‘‘আমরা একটি গুলি ছুড়লেই রুশ বাহিনীর দিকে থেকে ছুটে আসে ৫০টি বুলেট।’’

সবচেয়ে গুরুতর সংকট দেখা দিয়েছে ভুহলেদার শহরের যুদ্ধে। কমান্ডারেরা জানান, যেখানে প্রতি কোম্পানিতে ১২০ জন সৈন্য থাকা উচিত ছিল, পালানো, আহত ও নিহত মিলিয়ে এক সময় সেই সংখ্যা নেমে আসে মাত্র ১০ জনে। ফলে এলাকাটি দখল করতে রাশিয়ার তেমন বেগ পেতে হয়নি। সেনাদের বক্তব্য, সামনে তাঁদের রেখে বহু দূর থেকে নির্দেশ দিচ্ছেন কমান্ডারেরা—বাহিনী যেন এক ধরনের কারাগারে পরিণত হয়েছে।

অবশ্য রাশিয়াও এই একই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল। তবে প্রেসিডেন্ট পুতিন দ্রুত উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সামরিক চুক্তি করে সেই ঘাটতি পূরণ করেন। পাশাপাশি ওয়াগনার গ্রুপ ও চেচেন বাহিনীও মস্কোর হয়ে লড়ছে। বেলারুশও রাশিয়ার অন্যতম বড় কৌশলগত ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে।

অন্য দিকে, ইউক্রেন যদি সত্যিই অপ্রাপ্তবয়স্কদের সেনায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তা হলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নতুন মোড় নিতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে নিয়মের বিরুদ্ধে গোটা বিশ্ব কড়া অবস্থান নিয়েছিল, আজ তা ফের ইউক্রেনকে টেনে আনতে পারে ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দিকে। কোথায় গিয়ে থামবে এই যুদ্ধ, তা জানার জন্য বিশ্ব তাকিয়ে আছে।

Read more

Local News