ভারতের সবচেয়ে কঠিন সামরিক অভিযানের এক নাম ‘অপারেশন পবন’
ভারতের সামরিক ইতিহাসে বহু কঠিন অধ্যায় রয়েছে। কার্গিল যুদ্ধ, অপারেশন ব্লু স্টার, সন্ত্রাসবিরোধী নানা অভিযান— এসবের নাম অনেকেই জানেন। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় একই রকম গুরুত্বপূর্ণ হয়েও অনেকটাই চাপা পড়ে রয়েছে ‘অপারেশন পবন’, শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় সেনার অন্যতম কঠিন ও রক্তক্ষয়ী সামরিক অভিযান। ১৯৮৭ সালের এই অভিযানে প্রাণ হারান ১১৭১ জন ভারতীয় সেনা, আহত হন ৩৫০০ জনেরও বেশি। পরবর্তী প্রজন্মকে সেই আত্মবলিদানের ইতিহাস স্মরণ করাতেই এবার আনুষ্ঠানিক স্মরণসভা করল ভারতীয় সেনা।
■ অভিযানের পটভূমি— শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ ও ভারত
১৯৮০-র দশকে শ্রীলঙ্কায় সিংহলি সংখ্যাগরিষ্ঠ ও তামিল সংখ্যালঘুদের মধ্যে তীব্র গৃহযুদ্ধ চলছিল। তামিলদের অধিকারের বিষয়টি ভারতের কাছে ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর— সীমান্ত জুড়ে শরণার্থীর ঢল নামছিল, অস্থিরতা বাড়ছিল দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোতে। এই পরিস্থিতিতেই লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল ইলম (এলটিটিই) নামের জঙ্গিগোষ্ঠী পৃথক তামিল রাষ্ট্রের দাবিতে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করে দেয়।
পরিস্থিতি সামাল দিতে ভারত কূটনীতি ও সেনা শক্তি— দুই পথেই এগোয়। ১৯৮৭ সালের ২৯ জুলাই শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট জে. আর. জয়বর্ধনের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে ভারত। শর্ত ছিল— তামিল অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে এবং জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো অস্ত্র ছাড়বে। শান্তি বজায় রাখতে ভারত পাঠায় ইন্ডিয়ান পিস কিপিং ফোর্স (আইপিকেএফ)।
কিন্তু এলটিটিই কোনও ভাবেই অস্ত্র ফেলে আলোচনায় বসতে রাজি হয়নি। ফলে ভারতীয় সেনার সঙ্গে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
■ ‘অপারেশন পবন’— শুরু যুদ্ধের
এলটিটিই-র শীর্ষ নেতৃত্বকে নিকেশ করার লক্ষ্যেই ১৯৮৭ সালের ১১ অক্টোবর শুরু হয় অপারেশন পবন।
এর ঠিক আগের দিন, ব্রিগেডিয়ার জে. র্যালির নেতৃত্বে ভারতীয় সেনার ৯১তম ব্রিগেড জাফনার দিকে অগ্রসর হয়।
১১ অক্টোবর মধ্যরাতে ভারতীয় বায়ুসেনা হামলা চালায় এলটিটিই-র সদর দফতরে।
পরের পদক্ষেপ ছিল স্থল অভিযান। কামান ও পদাতিক নিয়ে সেনা পৌঁছোয় জাফনার কেন্দ্রের দিকে। কিন্তু এলটিটিই তৈরি ছিল। গভীর জঙ্গল, আইইডি, বাঙ্কার— সব মিলিয়ে তারা ভারতীয় সেনাকে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে ফেলে। রেডিয়ো ট্রান্সমিশন আটকিয়ে বিপর্যস্ত করে দেয় যোগাযোগ ব্যবস্থা। শিখ রেজিমেন্ট সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায়— এমনকি অনেক ক্ষেত্রে নিহত সেনাদের দেহ উদ্ধার করাও সম্ভব হয়নি।
■ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধেও পিছিয়ে না ভারতীয় সেনা
চরম ক্ষয়ক্ষতিও থামাতে পারেনি ভারতীয় সেনাকে। ভয়াবহ সংঘর্ষের পর ২৬ অক্টোবর, জাফনা শহর দখল করে নেয় ভারত। এলটিটিই গভীর জঙ্গলে পালিয়ে যায়। যদিও তাদের প্রধান নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ ধরা পড়েননি।
এই সময়েই অবিশ্বাস্য সাহসিকতার পরিচয় দেন মেজর আর পরমেশ্বরন। ২৫ নভেম্বর প্রভাকরণকে ধরতে অভিযান চালানোর সময় জঙ্গলে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। তবুও লড়াই থামাননি— আহত অবস্থাতেও বেশ কয়েকজন জঙ্গিকে নিকেশ করেন। পরে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করতে গিয়ে আরও জঙ্গিকে খতম করেন ভারতীয় সেনারা। মেজর পরমেশ্বরন সেই বীরত্বের জন্য পান মরণোত্তর পরমবীর চক্র।
■ অভিযানের পর রাজনৈতিক পরিবর্তন
অপারেশন পবনের সাফল্যের পরও শ্রীলঙ্কার জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলির ভারত-বিরোধী মনোভাব বাড়তে থাকে। সেনা প্রত্যাহারের দাবি ওঠে। কিন্তু রাজীব গান্ধী রাজি হননি।
১৯৮৯ সালে রাজীব নির্বাচনে পরাজিত হলে ক্ষমতায় আসেন রণসিংহে প্রেমদাস। তাঁর সিদ্ধান্তেই ১৯৯০ সালের ২৪ মার্চ ভারত শ্রীলঙ্কা থেকে সেনা সরিয়ে নেয়।
শ্রীলঙ্কার অস্থির পরিস্থিতি নিয়ে ভারত আরও দুই দশক নজর রাখে। অবশেষে ২০০৯ সালে এলটিটিই সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয় এবং প্রভাকরণ নিহত হয় সেনার হাতে।
■ উপসংহার— এক ভুলে যাওয়া অধ্যায়ের স্মরণ
১১৭১ শহিদ, ৩৫০০-রও বেশি আহত সেনা— অপারেশন পবন ছিল ভারতের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও কঠিন অধ্যায়। বহু বছর পর আনুষ্ঠানিক স্মরণসভা সেই আত্মবলিদানের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা।
বর্ষার ঝড়, জঙ্গলের অন্ধকার, শত্রুর প্রতারণা— তবুও দেশের স্বার্থে লড়াইয়ের নাম ‘অপারেশন পবন’।
এটি শুধু যুদ্ধ নয়— বীরত্ব, নীতিবোধ আর দায়িত্ববোধের এক অমলিন ইতিহাস।

