Sunday, November 30, 2025

ম্লান আলোয় থমকে ‘সাঁঝবাতি’: মালয়েশিয়ার স্বপ্নের আলোক-প্রকল্প কেন বছর ঘুরতেই হারাল জৌলুস?

Share

ম্লান আলোয় থমকে ‘সাঁঝবাতি’!

রাতের অন্ধকার নেমে এলে মালয়েশিয়ার সেমেনিহ শহরের রাস্তা যেন পরিণত হতো এক ভবিষ্যৎ-চলচ্চিত্রের দৃশ্যে। সাপের মতো বাঁক নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সড়ক, আর তাকে ঘিরে সবুজ আলোর লম্বা স্ট্রাইপ— চালকদের দিশা দেখাতো বিদ্যুৎ ছাড়াই। লাইটহাউস যেমন নাবিককে পথ দেখায়, তেমনই ‘সাঁঝবাতি প্রকল্প’ নামে পরিচিত এই উদ্যোগ মালয়েশিয়ার মানুষকে প্রথমে উচ্ছ্বসিত করেছিল। কিন্তু মাত্র এক বছরের মধ্যেই স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেল। কেন?


অন্ধকারে আলো ছড়ানোর অভিনব পরিকল্পনা

দুর্বল পরিকাঠামো এবং রাতে আলোর অভাবে মালয়েশিয়ার বহু জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটত নিয়মিত। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে দৃশ্যমানতা কমে যাওয়ায় সমস্যা আরও বেড়েছিল। এই সমস্যার সমাধান করতে সরকার ভাবল প্রচলিত বৈদ্যুতিক আলো বসানো নয়, বরং নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে রাস্তার উপরই এমন দাগ বসানো হবে যা সূর্যালোক শোষণ করে রাতে আলো ছড়াবে।

ফোটোলুমিনেসেন্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হয় সেই সবুজ আলো দেওয়া রাস্তা। দিনে সূর্যের আলো শোষণ করে দাগগুলি রাতে ৮–১০ ঘণ্টা নিজে থেকে আলো দিত। বিদ্যুৎ প্রয়োজন নেই, তার প্রয়োজন নেই— পরিবেশবান্ধব, অত্যাধুনিক এবং ভবিষ্যৎমুখী।

২০২৩ সালে সেমেনিহ শহরে প্রথম এই আলোকদাগ প্রয়োগ হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভবিষ্যতে কুয়ালালামপুরসহ আরও কয়েকটি শহরে এই প্রকল্প ছড়ানোর কথা ছিল।


শুরুর সাফল্যে আশাবাদী সরকার

প্রকল্প চালুর পর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায় সবুজ আলোয় উজ্জ্বল সেই রাস্তার ছবি। বহু নেটিজেন একে ‘মালয়েশিয়ার সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা’ বলে প্রশংসা করেন। কুয়াশা বা ভারী বৃষ্টির মধ্যেও আলো দেখা যেত, ফলে রাতের গাড়ি চালানো অনেক সহজ হতো।

এমনকি নেদারল্যান্ডস ও জাপানের মতো উন্নত দেশেও এই প্রযুক্তি পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে— তবে মালয়েশিয়া প্রথম বড় আকারে এটি রাস্তার আলোকসজ্জায় প্রয়োগ করেছিল।


কিন্তু বছর ঘুরতেই স্বপ্নে ফাটল— কেন ব্যর্থ হলো প্রকল্প?

প্রথম বড় ধাক্কাটি আসে খরচের বহর থেকে।

১. অত্যধিক ব্যয়

ফোটোলুমিনেসেন্ট দাগ তৈরিতে ব্যবহৃত স্ট্রন্টিয়াম অ্যালুমিনেটের দাম ছিল প্রতি বর্গমিটারে প্রায় ১৫ হাজার টাকা, যা সাধারণ সাদা রাস্তার রঙের তুলনায় ২০ গুণ বেশি
স্বাভাবিকভাবেই বৃহৎ আকারে পুরো দেশের রাস্তা ঢাকতে সরকারের পক্ষে তা অস্বাভাবিক ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে।

২. মালয়েশিয়ার আবহাওয়ার সঙ্গে অসামঞ্জস্য

মালয়েশিয়া একটি আর্দ্র, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশ। সেখানে প্রায় রোজই বৃষ্টি, তাপ, আর্দ্রতা এবং অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাব তীব্র।

ফলস্বরূপ—

  • দাগের উজ্জ্বলতা দ্রুত কমতে শুরু করে
  • উপাদান ক্ষয়ে যেতে থাকে
  • রং বিবর্ণ হয়ে যায়

এগুলো টিকতই পারছিল না এক–দেড় বছরের বেশি।

রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অতিরিক্ত খরচ লাগত, যা প্রকল্পকে আরও অযৌক্তিক করে তুলেছিল।

৩. সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বাতিল

সেলাঙ্গর ও জোহরে ৪০টিরও বেশি স্থানে প্রকল্প সম্প্রসারণের পরিকল্পনা থাকলেও, খরচ ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে তা স্থগিত করে সরকার।


জনসাধারণের উৎসাহও দ্রুত কমে গেল

প্রথমে ‘গ্লো-ইন-দ্য-ডার্ক’ রাস্তা দেখে মানুষ মুগ্ধ হলেও পরে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে—

  • রাস্তার গর্ত সংস্কারের কাজ হচ্ছে না
  • সাইনবোর্ড বিবর্ণ হচ্ছে
  • সাধারণ রক্ষণাবেক্ষণ উপেক্ষিত

অতএব, সরকারের অগ্রাধিকারের জায়গায় এমন ব্যয়বহুল প্রকল্প থাকা উচিত কি না— সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন নাগরিকেরা।


শেষকথা

মালয়েশিয়ার ‘সাঁঝবাতি প্রকল্প’ ছিল সাহসী, আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব ভাবনার নিদর্শন। কিন্তু উচ্চ ব্যয়, আবহাওয়ার প্রভাব এবং প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে এর আলো দীর্ঘস্থায়ী হলো না। অন্ধকারে আলো জ্বালানোর স্বপ্ন তাই বছর ঘুরতেই ম্লান হয়ে গেল।

Read more

Local News