মহাকুম্ভের প্রান্তরে বেজে চলেছে মহা ভারতের সুর
মকর সংক্রান্তির পুণ্যস্নানের ভোর। নাগা সন্ন্যাসীদের শোভাযাত্রা ক্রমে এগোচ্ছে ত্রিবেণী সঙ্গমের পথে। চারদিকে অন্ধকার, শীতল বাতাসের স্পর্শ। ভোর চারটায় স্নান সেরে ফিরে আসার পথে, প্রয়াগরাজের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে যেন এক অভূতপূর্ব অনুভূতির স্পর্শ পেলাম। ধর্ম আর পুণ্যের ভাবনাকে ছাপিয়ে এই মুহূর্তে যেন ভারতবর্ষের চিরন্তন রূপ আমার সামনে ভেসে উঠল।
নাগাদের স্নানযাত্রা: প্রথম অধিকার তাঁদেরই
মকর সংক্রান্তির স্নান মানেই নাগা সন্ন্যাসীদের অধিকার। প্রতিটি আখড়া থেকে শুরু হওয়া শোভাযাত্রা যেন এক বিশাল ধারা, যা মিলিত হচ্ছে সঙ্গমে। সামনে দেহে ছাই মেখে, কটিবস্ত্র পরা নাগারা, তাঁদের পেছনে কৌপীনধারী সন্ন্যাসীরা। আরও পেছনে ধীর পায়ে চলছেন গেরুয়া পরিহিত সাধুসন্ন্যাসিনী। এক আশ্চর্য শৃঙ্খলা ও ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি।
ভোরের আলো যখন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল, তখন দেখা মিলল নাগা সন্ন্যাসিনীদের। দেবীকালিকার মতো শক্তিময়ী তাঁদের চলন। তাঁদের শোভাযাত্রা যেন এক সঙ্গীত— ভারতের মাটিতে সময়ের গভীর সুর।
মহাকুম্ভ: ইতিহাস আর আধুনিকতার মেলবন্ধন
শোনা যায়, প্রতি ১৪৪ বছর অন্তর এই মহাকুম্ভ আসে। তখন স্নানের মাধ্যমে পুণ্যের অর্জন হয়। তবে সত্যি কথা বলতে, ত্রিবেণী সঙ্গমের পবিত্র স্নানের চেয়েও যা আমাকে আকর্ষণ করেছে, তা হল এই সমগ্র আয়োজন। মহাকুম্ভ যেন ভারতবর্ষের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
ধুনির পাশে বসা ছাই মাখা সন্ন্যাসী, আর তার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা আধুনিক যুগের QR কোড ব্যবহার করা ব্যবসায়ী— এই মেলাই আজকের ভারত। একদিকে মাটির পাত্রে প্রসাদ বিক্রি, অন্যদিকে বোতলজাত জলের দাম স্ক্যান করে মেটানো। এক প্রৌঢ় মাথায় বোড়ি নিয়ে হাঁটছেন, আর এক তরুণী টিশার্টে মিকি মাউসের ছবি পরে আধুনিকতার ছোঁয়া দিচ্ছেন। এসইউভি-তে চড়ে আসা ধনী আর চপ্পলবিহীন দরিদ্রের সহাবস্থান।
এই বৈচিত্র্যই ভারতের মূল শক্তি। পোশাক, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, ভৌগোলিক দূরত্ব— সব কিছু মুছে গিয়ে এক অভিন্ন সুরের জন্ম দিয়েছে। শত মত, পথ, বিশ্বাস মিলেমিশে এক অবিচ্ছেদ্য ভারতের গল্প বলছে।
ভিআইপি তাঁবু আর আট ডিগ্রির কুয়াশা
এ দেশে ভিআইপি-র অভাব নেই। তাই ভিআইপি তাঁবুও আছে। তবে এর পাশেই খোলা আকাশের নিচে লাখো সাধারণ মানুষ কাটাচ্ছেন ঠান্ডায় ভরা রাত। আট ডিগ্রি সেলসিয়াসে তাঁদের ঘুম, আর ভোর হতেই সেই স্রোত মিশে যাচ্ছে সঙ্গমের পথে। একদিকে শত বিরোধ, অন্যদিকে এই সহাবস্থান। মহাকুম্ভ যেন থেকে থেকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, ভারত বরাবরই এক।
সকালের সূর্যের আলোয় যখন ভিড়ের স্রোত চকচক করে উঠল, তখন মনে হল— এটাই ভারতের শক্তি। এক সুরে বাজছে শঙ্খধ্বনি, বাঁশি আর খালি গলার সঙ্গীত। সমস্ত পার্থক্য ভুলে সবাই একাত্মায়, এক লক্ষ্যে।
ভারতের আত্মা: চিরন্তন এবং ঐক্যবদ্ধ
এই মহাকুম্ভের বিস্ময়ের মধ্যে যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে ভারতবর্ষের আত্মা। ঠান্ডা জলে দাঁড়িয়ে মনে হল, সমুদ্র মন্থনের সেই কাহিনির অমৃতকুম্ভ থেকে যেন প্রসাদ হিসেবে কয়েক ফোঁটা এ ভিড়ের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
অস্ফুটে মনে পড়ল সেই চিরপরিচিত মন্ত্র— “হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে…”। মহাকুম্ভ শুধু এক উৎসব নয়, এটি একটি অনুভূতি। যেখানে ধর্ম, ইতিহাস, আধুনিকতা আর ভারতবর্ষের চিরন্তন ঐক্যের সুর একসঙ্গে মিলে যায়।
সত্যিকারের সাধ্বী নাকি শুধুই লোকদেখানো! নেটপ্রভাবী হর্ষা রিচারিয়া নিয়ে কেন এত বিতর্ক?