মমতার ‘অগ্নিপরীক্ষা’
আরজি কর হাসপাতালের ভেতরে চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পর রাজ্যজুড়ে তৈরি হয়েছিল নজিরবিহীন জনআন্দোলন। গত বছরের ৯ আগস্ট সকালে ঘটে যাওয়া এই বর্বর ঘটনা জনমনে গভীর আঘাত হানে। এই আন্দোলনকে ঘিরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘ শাসনকালের অন্যতম কঠিন সময় শুরু হয়েছিল। নাগরিক আন্দোলনের ঢেউ এবং জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিবাদ মিলে এক নতুন ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছিল প্রশাসনের ওপর।
মমতার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া এবং পদক্ষেপ
এই ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের ফাঁসির দাবি জানিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে দলের মহিলা নেত্রী ও সাংসদরা মিছিল করেছিলেন। তবুও, সেই মিছিলের পর সরকারের অবস্থান পরিবর্তনে আন্দোলনের প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। নাগরিক আন্দোলনের ধারায় ভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান ও অংশগ্রহণও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা এক বাক্যে স্বীকার করেন, আরজি কর-কাণ্ড ছিল মমতার প্রশাসনিক দক্ষতার অন্যতম কঠিন পরীক্ষা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, পুলিশ, এবং স্বাস্থ্য বিভাগের ব্যর্থতার জেরে জনরোষ বাড়তে থাকে। চাপের মুখে কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলসহ বেশ কিছু শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে সরাতে বাধ্য হয় সরকার।
নাগরিক আন্দোলন: নতুন চ্যালেঞ্জ
এই আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল এর দলহীন চরিত্র। কোনও রাজনৈতিক দলের ঝাণ্ডার অধীনে না থেকেও আন্দোলনটি বিশাল জনগোষ্ঠীর সমর্থন লাভ করেছিল। সিপিএম ও বিজেপি কৌশলে এই আন্দোলনে জায়গা করে নিতে চাইলেও তা মূলত নাগরিকদেরই রয়ে গিয়েছিল। বাংলার রাস্তায় মহিলাদের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছিল নতুন ধরনের মিছিল। ‘মেয়েদের রাত দখল’ থেকে শুরু করে মানববন্ধন, এসব কার্যক্রম পূর্বের আন্দোলনের ধারা থেকে আলাদা ছিল।
গ্রামাঞ্চলে আন্দোলনের প্রভাব কম থাকলেও শহর ও মফস্বলে এই নাগরিক আন্দোলনের ঝাঁজ প্রশাসনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মহিলাদের রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানানো তৃণমূলের জন্যও অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, কারণ মহিলাদের সমর্থন বরাবরই ছিল মমতার নির্বাচনী সাফল্যের অন্যতম ভিত্তি।
মমতার কৌশল এবং সংকট মোকাবিলা
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিক কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন এবং তাঁদের দাবিগুলোর প্রতি মনোযোগ দেন। স্বাস্থ্য ভবনের সামনে সরাসরি উপস্থিত হয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলার মধ্য দিয়ে একটি মধ্যপথে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত ২১ অক্টোবর নবান্নের বৈঠকে তিনি পরিস্থিতির রাশ হাতে নেন।
এই বৈঠকের পরই জুনিয়র ডাক্তারদের আমরণ অনশন প্রত্যাহার করা হয়। যদিও তাঁরা দাবি করেন, তাঁদের সিদ্ধান্ত নবান্নের বৈঠকের প্রভাবমুক্ত। নাগরিক আন্দোলনের ঝাঁজও এরপর থেকে ধীরে ধীরে কমে আসে।
রাজনৈতিক পরিণতি
আরজি কর-কাণ্ডের প্রভাব তৃণমূলের রাজনীতিতেও পড়েছিল। তবে চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও দলটি ছয়টি বিধানসভা আসনে উপনির্বাচনে জয় লাভ করে। উত্তরবঙ্গের একটি আসন বিজেপির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজেদের শক্তি আরও বাড়ায়। এর ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন।
শেষের দিকের সংকট এবং মমতার প্রতিক্রিয়া
মুখ্যমন্ত্রীর মতে, আরজি কর মামলার রায় তাঁকে হতবাক করেছে। অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের মৃত্যুদণ্ড না হওয়ায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “কীভাবে এই ঘটনা বিরলের মধ্যে বিরলতম হিসেবে বিবেচিত হল না?” রায়ের এই দিকটি তাঁকে কিছুটা ব্যাকফুটে ঠেলে দিলেও সামগ্রিকভাবে মমতা এই অগ্নিপরীক্ষা থেকে সাফল্যের সঙ্গে বেরিয়ে আসেন।
উপসংহার
আরজি কর-কাণ্ড মমতার প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য এক বিরাট পরীক্ষা ছিল। আন্দোলনের তীব্রতা, নাগরিক সমাজের চাপ, এবং দলীয় নেতৃত্বের উদ্বেগ একত্রে তাঁকে এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করে। তবে তাঁর দক্ষতা এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাঁকে এই সংকট মোকাবিলায় সহায়তা করেছে।
আজ আন্দোলন স্তিমিত, নাগরিক সমাজ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গিয়েছে, এবং তৃণমূলের রাজনৈতিক অবস্থান আরও দৃঢ় হয়েছে। কিন্তু এই অধ্যায় মমতার শাসনকালের অন্যতম উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হিসেবেই ইতিহাসে থেকে যাবে।

