মত্ত চালক গাড়ির নীচে পিষে দেবে না তো?
কলকাতার ফুটপাতে জীবন কাটানো মানুষের জন্য রাতের সময়টা যেন এক অবিরাম উদ্বেগের গল্প। শীতের রাতে, রাস্তার পাশে বা উড়ালপুলের তলায় নিজেদের ঘর বানিয়ে থাকা পরিবারগুলো প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামে যেভাবে ত্রস্ত, তা শুধুমাত্র তাদেরই বোঝা সম্ভব। গড়িয়াহাট উড়ালপুলের নীচে সুনীতা কুণ্ডু, প্রিয়াঙ্কা প্রামাণিক, সুফিয়া মণ্ডলের মতো কিছু মহিলা ওই ফুটপাতে বসে রান্না করছিলেন, আর পাশে কম্বল গায়ে ঘুমাচ্ছিলেন তাঁদের সন্তানরা। সুনীতা জানালেন, রাতের বেলা তাঁরা ফুটপাতের পাশে বিছানা পেতে ঘুমোন, মশারি টাঙিয়ে কাপড় বিছিয়ে। তবে, এই অবস্থা বছরের পর বছর চলতে থাকা অভ্যস্ত জীবনের এক অদৃশ্য আতঙ্ক, যা এখন যেন আর ভয়ের বদলে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
সুনীতা বললেন, “বেশি রাতে রাস্তা দিয়ে খুব জোরে গাড়ি চলে, মোটরবাইকও চলে। আমি ভয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠি, যদি কোনো গাড়ি বা মোটরবাইক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফুটপাতে উঠে এসে আমাদের পিষে দেয়। আর যখন হর্নের শব্দ শুনি, বাচ্চারা ভয় পেয়ে আমাদের কাছে এসে ঘুরে দাঁড়ায়।” ফুটপাতে ঘুমানোর অভিজ্ঞতা থেকে তাদের এই ভয় যেন কিছুতেই সয়ে না, রাতের সময়টা যেন অন্ধকারে ডুবে থাকা এক অবর্ণনীয় আতঙ্কের মাঝে কাটে।
আরেক বাসিন্দা, প্রিয়াঙ্কা, জানান যে, “এখানে কোনো সিসি ক্যামেরা নেই, ফুটপাতের দোকানের ক্যামেরা থেকেও ভালো করে দেখা যায় না। উড়ালপুলের নীচে আলোর ব্যবস্থা নেই, অথচ ভোটের আগে নেতারা এসে আলো দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তারপর থেকে তাদের আর দেখা মেলেনি। একটু আলো থাকলে আমাদের শান্তি আসত।”
কিছুদিন আগে কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (বস্তি) স্বপন সমাদ্দার ফুটপাতবাসীদের জন্য নতুন উদ্যোগ নিয়েছেন, যেখানে নৈশাবাসে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, শহরজুড়ে ৪০টি নৈশাবাস তৈরি করা হয়েছে, যেখানে ফুটপাতবাসীরা নিরাপদে থাকতে পারবেন। তবে, সুনীতা এবং তাঁর মতো আরও অনেকে জানান, নৈশাবাসে তারা যেতে চান না। বাপ্পা শেখ, গড়িয়াহাটের আরেক বাসিন্দা, বললেন, “নৈশাবাসে গেলে ঘুম আসবে না, কারণ সেখানে দিনের বেলা থাকতে দেওয়া হয় না। কাজকর্ম শেষ করে রাতেই ফিরে আসতে হয়। তখন আমাদের জিনিসপত্র কোথায় রাখা হবে?”
এছাড়া, নৈশাবাসে স্বামী-স্ত্রীকে একসঙ্গে থাকতে দেওয়া হয় না, ছেলেমেয়েদের ঘর আলাদা করা হয়। এসব সমস্যার কারণে অনেকেই ফুটপাতের অভ্যস্ত জীবনের বাইরে যেতে চান না, এবং পরিবারের সঙ্গেই থাকতে চান।
হেস্টিংসের কাছে ফুটপাতে কিছু নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যেমন পুলিশ গার্ডরেল বসিয়েছে, কিন্তু তাতেও সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়। রুমা দাস, একজন ফুটপাতবাসী, জানান, “রাতে আমি গভীর ঘুমোতে পারি না, একটু শব্দ হলেই জেগে উঠি। তবে দিনের বেলায় অনেকটা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারি।”
এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে হেস্টিংসের ফুটপাতে শিক্ষিকা ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন। রুমা বললেন, “পড়াশোনা করলে ওদের বোধবুদ্ধি বাড়বে, আর যদি এখান থেকে বেরোতে পারে, তা হলে সেটা খুব ভাল হবে।”
ফুটপাতবাসীদের নিরাপত্তা নিয়ে দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্য সমীরণ মল্লিক জানান, “গত কয়েক বছরে ফুটপাতে মেয়েরা এবং শিশুদের নিরাপত্তা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে, আমরা ফুটপাতের শিশুদের নাটকের মাধ্যমে সুরক্ষার শিক্ষা দিচ্ছি।” কিন্তু, প্রশ্ন থেকেই যায়—শহরের ফুটপাতে এমন জীবনের সঙ্গে কি নিরাপত্তা সত্যিই নিশ্চিত? শীতের সন্ধ্যায় এক মা, শিশুকন্যাকে লেপ চাপা দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেন, আর মায়ের একটাই অভ্যাস—ঘুমোতে গেলেও জেগে থাকতে হয়, যেন কোনো অঘটন ঘটে না যায়। ফুটপাতে রাত শেষে, এই অনিশ্চয়তার দীর্ঘ রাতই মা ও মেয়ের জীবনের এক বাস্তবতা।
4o mini