Monday, December 8, 2025

ভাঙনের অগোছালেই লুকিয়ে শৃঙ্খলা! ভঙ্গুর বস্তুর ভাঙন-রহস্য উন্মোচনে নতুন পদার্থবিদ্যা সমীকরণ আবিষ্কার

Share

ভাঙনের অগোছালেই লুকিয়ে শৃঙ্খলা!

দৈনন্দিন জীবনে ভঙ্গুর বস্তু পড়ে ভেঙে যাওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা। কাচ, চিনির কিউব, এমনকি এক ফোঁটা তরল—কীভাবে, কত টুকরো বা কত ফোঁটায় বিভক্ত হবে, তা পূর্বানুমান করা এত দিন পর্যন্ত অসম্ভবই মনে করা হত। কারণ ভাঙনের প্রক্রিয়া যেন সম্পূর্ণ এলোমেলো, বহু ভিন্ন ভিন্ন উপাদানের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু সেই ধারণায় বড়সড় বদল আনলেন ফ্রান্সের আই-মার্সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এমানুয়েল ভিলারমো। তিনি দাবি করেছেন, ভাঙনের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক নিয়ম, এক শৃঙ্খলাবদ্ধ সূত্র, যা যেকোনও ভঙ্গুর বস্তুর ভাঙন-প্যাটার্ন ব্যাখ্যা করতে সক্ষম।

এই যুগান্তকারী গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জার্নাল Physical Review Letters-এ। এর পর থেকেই পদার্থবিদ্যার জগতে আলোচনার ঝড় উঠেছে।


এত দিন যা ছিল এলোমেলো, সে সব কি সত্যিই নিয়ম মেনে চলে?

বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে ভঙ্গুর পদার্থের ভাঙন নিয়ে গবেষণা করলেও ভাঙন-প্যাটার্ন এতটাই বিশৃঙ্খল মনে হত যে একে সূত্রবদ্ধ করা অসম্ভব ছিল। কখনও তাঁরা ভাঙনকে ‘ফেজ় ট্রানজিশন’ হিসাবে দেখেছেন, কখনও আবার মনে করেছেন এটি নিছক মাইক্রোস্কোপিক প্রক্রিয়া। কিন্তু নতুন গবেষণা বলছে, এদের মধ্যে কোনওটাই পুরোপুরি যথাযথ নয়।

ভিলারমো ভাঙন প্রক্রিয়ার সবচেয়ে ক্ষুদ্র, সূক্ষ্ম অংশগুলি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন—ভাঙন মোটেও এলোমেলো ভাবে হয় না। বরং ভাঙন এমনভাবে ঘটে যাতে বস্তুর এনট্রপি বা বিশৃঙ্খলা সর্বোচ্চ হয়। অর্থাৎ, একটি বস্তুর ভাঙনের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো যতটা সম্ভব বেশি সংখ্যক টুকরোয় নিজেকে ভেঙে ফেলা। ভিলারমোর ভাষায়—এটি “Maximum Randomness Principle”।


একটি চিনির কিউব ভাঙলে কত টুকরো হবে? তারও সমীকরণ আছে!

হতবাক করা বিষয় হল—ভাঙনের সময় কোন মাপের টুকরো তৈরি হবে, ১ সেন্টিমিটার কিউব ভেঙে কত মিলিমিটারের অংশ তৈরি হবে, তারও নির্দিষ্ট গাণিতিক পদ্ধতি আছে বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা।

আইআইটি কানপুরের অধ্যাপক কৌশিক ভট্টাচার্য এই আবিষ্কারকে “নতুন রহস্য উন্মোচন” বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, প্রকৃতির ধর্মই হলো সাজানো অবস্থা থেকে অগোছালো অবস্থায় যাওয়া। ভাঙন সেই প্রক্রিয়ারই অংশ। নতুন সূত্রটি সেই অগোছালো হওয়াকে কতখানি এবং কী ভাবে ঘটবে, তা নির্ধারণ করতে সাহায্য করবে।


তরলের ক্ষেত্রেও কার্যকর এই সূত্র!

এটি কেবল কঠিন বস্তুর ক্ষেত্রেই নয়, তরলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একটি জলের ফোঁটা পড়ে মাটিতে ছিটকে কতগুলো ক্ষুদ্র ফোঁটায় বিভক্ত হবে—এখন তা-ও হিসাব করা সম্ভব হবে।


কেন এই আবিষ্কার এত গুরুত্বপূর্ণ?

গবেষকেরা মনে করছেন, এই জটিল ভাঙন-সমীকরণ ভবিষ্যতে বাস্তব জীবনের বহু সমস্যার সমাধান করবে। যেমন—

  • পাহাড়ধসের পূর্বাভাস:
    জলবায়ুর পরিবর্তনে বা ভারী বৃষ্টিতে পাহাড় থেকে বড় বড় শিলা ভেঙে পড়ে। নতুন সূত্র ব্যবহার করে আগে থেকেই অনুমান করা সম্ভব হবে কোন শিলা কত টুকরো হবে, কত দূর ছড়াবে, কতটা বিপদ ডেকে আনতে পারে।
  • প্রাণহানি কমানো:
    পাহাড়ি অঞ্চলে বিপর্যয় ঠেকাতে আগাম ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
  • অধুনাতন নির্মাণ প্রযুক্তি:
    ভবিষ্যৎ ভবন নির্মাণে কোন অংশ ভাঙলে কীভাবে টুকরো হবে, তার ধারণা পাওয়া যাবে, যা নিরাপত্তা বাড়াবে।

শেষ কথা

যে ভাঙন এত দিন বিশৃঙ্খলা বলে মনে হত, তার ভেতরেও যে লুকিয়ে আছে নির্দিষ্ট পদার্থবিদ্যা ও শৃঙ্খলা—ভিলারমোর এই আবিষ্কার মানবজ্ঞানকে সেই দিকেই এক অপূর্ব নতুন পথে এগিয়ে দিল। বিজ্ঞানের চোখে, অগোছালোর মধ্যেও লুকিয়ে থাকে পরম সৌন্দর্য—শৃঙ্খলা।

Read more

Local News