বিজেপির ‘ভেলকি-নীতি’!
ভারতের রাজনীতিতে বিজেপি শুধু তাদের কৌশলগত চালের জন্যই নয়, বরং অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যও পরিচিত। বিশেষত, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তারা একেবারে ‘টুপির ভিতর থেকে খরগোশ’ বের করার মতো চমক দেয়। একের পর এক ‘অপরিচিত’ নেতা, যাদের স্থানীয় রাজনীতিতেও তেমন প্রভাব ছিল না, হঠাৎ করেই গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদে বসে যাচ্ছেন। দিল্লি, ওড়িশা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগড়ে বিজেপির নতুন মুখ্যমন্ত্রীরা যেন একেকজন ‘ছায়ামানুষ’— নির্বাচনের আগে যাদের নামও শোনা যায়নি!
কিন্তু কীসের ভিত্তিতে বিজেপি এই অজানা নেতাদের মুখ্যমন্ত্রী বানাচ্ছে? কেন এই রহস্যময় ফর্মুলা?
কে কোন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হলেন?
- দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী রেখা গুপ্ত – এবিভিপির প্রাক্তন নেত্রী, শালিমার বাগ থেকে প্রথমবার বিধায়ক হয়েই মুখ্যমন্ত্রীর পদে।
- ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী মোহনচরণ মাঝি – আরএসএসের স্কুলশিক্ষক থেকে সরপঞ্চ, এরপর চারবারের বিধায়ক হয়ে হঠাৎ মুখ্যমন্ত্রী।
- মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মোহন যাদব – ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা, একসময় শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন, এখন রাজ্যের মুখ।
- রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী ভজনলাল শর্মা – এবিভিপি থেকে শুরু, সরপঞ্চের পদ থেকে ধাপে ধাপে উঠে এসে প্রথমবার বিধায়ক হয়েই মুখ্যমন্ত্রী।
- ছত্তীসগড়ের মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণুদেও সাই – আদিবাসী সমাজ থেকে উঠে আসা, লোকসভার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থাকলেও রাজ্য রাজনীতিতে ছিলেন অনুচ্চারিত।
এঁদের একটাই মিল— সকলেই আরএসএসের ‘পছন্দের তালিকায়’ ছিলেন, কিন্তু জনমানসে তেমন পরিচিত ছিলেন না।
কেন এই চমক? বিজেপির ফর্মুলা কী?
১. আরএসএসের ছায়া ও ‘ভক্তি’
বিজেপি যে মুখ্যমন্ত্রীদের বেছে নিচ্ছে, তারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে আরএসএসের ঘনিষ্ঠ। দীর্ঘদিন ধরে সংঘ পরিবারের আদর্শের অনুগামী থাকা ব্যক্তিরাই নেতৃত্বে আসছেন। বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের মতে, জনপ্রিয়তা নয়, বরং আদর্শের প্রতি আনুগত্যই মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার প্রধান শর্ত।
২. পিছনের সারি থেকে নেতা তুলে আনা (অন্ত্যোদয় নীতি)
বিজেপি ২০১৪ সাল থেকে ওবিসি, দলিত ও জনজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে শক্ত ঘাঁটি গড়ার চেষ্টা করছে। তাই, এই শ্রেণি থেকে নেতাদের তুলে আনা তাদের অন্যতম প্রধান কৌশল। মোদী-শাহদের মতে, যদি জনগণ দেখেন, ‘তাদের মধ্য থেকে’ কেউ মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন, তাহলে বিজেপির প্রতি আস্থা বাড়বে।
৩. ব্যক্তি নয়, দলকেই বড় করা
বিজেপির দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলো ‘ব্যক্তি নির্ভরতা’ কমিয়ে দলকে শক্তিশালী করা। অতীতে রাজস্থানে বসুন্ধরা রাজে বা কর্ণাটকে ইয়েদুরাপ্পার মতো জনপ্রিয় নেতাদের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার ওপর নির্ভরতা বিজেপিকে বিপদে ফেলেছিল। তাই এবার দলীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য অতি-জনপ্রিয় কোনো নেতাকে মুখ্যমন্ত্রী বানানো হচ্ছে না।
একা ব্যতিক্রম যোগী আদিত্যনাথ?
এই ফর্মুলা অনুসরণ করেও বিজেপির একমাত্র ব্যতিক্রম হলো উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। ২০১৭ সালে তিনি যখন মুখ্যমন্ত্রী হন, তখনও তিনি আরএসএসের আনুগত্যের বাইরে ছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেকে বিজেপির হিন্দুত্বের প্রধান মুখ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। এখন তিনি এতটাই শক্তিশালী যে, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও তাঁকে সরানোর কথা ভাবতে ভয় পায়।
এই নীতির ভবিষ্যৎ কী?
বিজেপির এই ‘অপ্রত্যাশিত নেতা বাছাই’ কৌশল কি দীর্ঘমেয়াদে সফল হবে? না কি দলীয় নেতৃত্বের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণের কারণে ভবিষ্যতে সমস্যার সৃষ্টি হবে? এখনই এর উত্তর পাওয়া কঠিন। তবে আপাতত এটা স্পষ্ট— বিজেপি তার নিজস্ব ‘ভেলকি-নীতি’ বজায় রেখেই মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন করছে, আর তা নিয়ে জনমানসে চমক তৈরি করছে!
গবেষণার আড়ালে সামরিক পরিকল্পনা? সমুদ্রের গভীরে চিনের রহস্যময় কেন্দ্র ঘিরে উদ্বেগ

