বন্ধ হয়ে গিয়েছে পুঁটিরামের পুরনো দোকান
কলকাতা শহরের অজস্র পুরনো এবং ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকান, যেখানে প্রতিটি পদ যেন একটা সময়ের সাক্ষী। এমনই একটি দোকান ছিল পুঁটিরাম। আর্মহার্স্ট স্ট্রিটের এই মিষ্টির দোকান, যা শতাধিক বছর ধরে শহরের খাদ্য সংস্কৃতির অংশ ছিল, সম্প্রতি বন্ধ হয়ে গেছে। এই দোকানটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, শহরের মিষ্টি প্রেমীদের মধ্যে এক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু কেন বন্ধ হল এই পুরনো বিপণি? নতুন প্রজন্মের রুচি কি পরিবর্তিত হয়েছে, নাকি এর পিছনে আরও কোনও কারণ রয়েছে?
আর্মহার্স্ট স্ট্রিটের পুঁটিরাম বন্ধ হওয়ার সিদ্ধান্তে দোকানের মালিক, পরেশ মোদক জানিয়েছেন, নতুন প্রজন্মের অনাগ্রহের কারণে নয়, বরং বয়স এবং শারীরিক সমস্যা থাকার কারণে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তাঁর পরিবারের সদস্যরা তিনটি দোকান চালাতেন, তবে একটির আগে থেকেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর্মহার্স্ট স্ট্রিটের দোকানটি দীর্ঘদিন চালানোর পর, ৭০ বছরের কাছাকাছি বয়সে এসে পরেশবাবু আর ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারছিলেন না। পরবর্তী প্রজন্মও ব্যবসা চালাতে আগ্রহী ছিল না, ফলে দোকান বন্ধ করে দিতে হয়।
পুঁটিরামের খ্যাতি ছিল তার নোনতা এবং মিষ্টি খাবারের জন্য। বিকেলবেলা সেখানে ভাজার জন্য রাধাবল্লভী, কচুরি, এবং আলুর দম প্রস্তুত করা হত, যা খেতে আসতেন বইপাড়ার ছাত্রছাত্রীরা। এর সঙ্গে ছিল আরও কিছু মিষ্টি, যেমন সন্দেশ এবং ছানার পোলাও। বিশেষ করে, আলুর দমের স্বাদ ছিল এমন, যা অন্য কোথাও পাওয়া যেত না। সেই আলুর দমে হালকা কাঁচালঙ্কা দিয়ে শিথিল করা হত স্বাদ, আর সেটা মাখিয়ে খাওয়া হত রাধাবল্লভী বা কচুরির সঙ্গে।
কলকাতার এক কবি ও প্রকাশক সুকল্প চট্টোপাধ্যায়, যিনি ছাত্রজীবনে নিয়মিত বইপাড়ায় আসতেন, তাঁর ভাষায় পুঁটিরামের এই শাখাটি ছিল তার জীবনের অঙ্গ। তিনি বলেছেন, পুঁটিরামে গিয়ে খাওয়া রাধাবল্লভী, কচুরি এবং আলুর দম যেন এক বিশেষ স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। এই শাখার খাবারের বিশেষত্ব ছিল, শিঙড়ার পুরে কাজুবাদাম, কিশমিশের মতো ড্রাইফ্রুটও ব্যবহার করা হত। পুঁটিরামের মিষ্টি যেমন চিরকাল প্রিয় ছিল, তেমনি তার নোনতা খাবারও শহরের বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
বয়স বাড়ার কারণে পরেশ মোদক অবশ্য আর নতুন প্রজন্মের সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যেতে চাইছিলেন না। তিনি বলেন, “মজার বিষয় হলো, আমাদের দোকানের নোনতা খাবারের খ্যাতি সেই প্রজন্ম পর্যন্ত অটুট ছিল, যারা নিয়মিত এখানে আসতেন।” তবে, পুঁটিরাম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর, বইপাড়ার এক পুরোনো স্মৃতি হারিয়ে গেল।
পরেশ মোদক এই দোকান বিক্রি করে দিতে চাননি, কারণ তিনি মনে করেন, এটি তাঁর পরিবারের ঐতিহ্য এবং তাঁরা গুডউইলের সঙ্গে আপস করে বিক্রি করতে চান না। বিশেষ করে, দোকানের নোনতা খাবারগুলি বিশেষ ধরনের স্মৃতি হয়ে ওঠে শহরের মানুষের জন্য। তাঁর মতে, পুঁটিরামের মিষ্টি এবং খাবারের প্রতি শহরের মানুষের ভালোবাসা ছিল গভীর এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা অটুট ছিল।
আজ, সূর্য সেন স্ট্রিটে পুঁটিরাম একটি মাত্র শাখা চালু আছে, কিন্তু আর্মহার্স্ট স্ট্রিটের এই বন্ধ হওয়া দোকানটি শুধুই স্মৃতি হয়ে গেল। কলকাতার ঐতিহ্য, বিশেষ করে তার মিষ্টির দোকানগুলোর মধ্যে একটা জায়গা তৈরি করেছিল পুঁটিরাম, যেখানে একেবারে সাধারণ খাবারের মধ্যেও অসাধারণ কিছু ছিল।
এখন, কলকাতার খাদ্য-সংস্কৃতির ইতিহাসে, পুঁটিরামের বন্ধ হওয়া এক দুঃখজনক অধ্যায় হয়ে রইল। আর সে সঙ্গে হারিয়ে গেল কিছু বিশেষ স্বাদ এবং সেই স্বাদকে স্মরণ করতে বহু মানুষই এখন মন খারাপ করছেন।
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করে আমলকি, কিন্তু সেই ফলটি চোখের ক্লান্তি কী ভাবে দূর করবে?