Monday, February 24, 2025

প্রাথমিকে নিয়োগ কেলেঙ্কারি: কার সুপারিশে কত জনের চাকরি? তদন্তে সিবিআই

Share

প্রাথমিকে নিয়োগ কেলেঙ্কারি!

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে উত্তাল রাজ্য-রাজনীতি। সিবিআই-এর হাতে আসা একাধিক নথিতে উঠে এসেছে বেশ কয়েকজন ‘প্রভাবশালী’ নেতার নাম, যাঁরা বিভিন্ন চাকরিপ্রার্থীর জন্য সুপারিশ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর ভাই ও প্রাক্তন সাংসদ দিব্যেন্দু অধিকারী, বিজেপি নেত্রী ও প্রাক্তন আইপিএস অফিসার ভারতী ঘোষ, তৃণমূল সাংসদ মমতাবালা ঠাকুর এবং তৃণমূল বিধায়ক শওকত মোল্লা। বিকাশ ভবনে চালানো তল্লাশিতে উদ্ধার হওয়া এই নথি তদন্তে নতুন মোড় এনেছে।

সুপারিশের জোরেই কি চাকরি? তদন্তে নেমেছে সিবিআই

সিবিআই সূত্রের খবর, ৩২৪ জন চাকরিপ্রার্থীর একটি তালিকা তাদের হাতে এসেছে, যেখানে নামের পাশে প্রভাবশালী নেতাদের সুপারিশকারীর নাম রয়েছে। তদন্তকারীদের সন্দেহ, এই তালিকায় যাঁরা আছেন, তাঁদের অনেকেই সুপারিশের মাধ্যমে চাকরি পেয়েছেন। তবে এই প্রার্থীরা কেবল সুপারিশের ভিত্তিতেই চাকরি পেয়েছেন, নাকি তাঁরা যোগ্য ছিলেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত কোনো ‘প্রভাবশালী’ নেতাকে তলব করা না হলেও, কিছু চাকরিপ্রাপ্ত প্রার্থীদের ইতিমধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

২০২৪ সালের জুন মাসে বিকাশ ভবনে অভিযান চালানোর সময় সিবিআই কর্মকর্তারা এই নথি উদ্ধার করেন। নথিতে দেখা গেছে, অনেক নামের পাশে ‘এমপি’ (সাংসদ) ও ‘এমএলএ’ (বিধায়ক) লেখা রয়েছে। যেমন, দিব্যেন্দু অধিকারীর নামের পাশে ‘এমপি’ লেখা রয়েছে, মমতাবালা ঠাকুরের ক্ষেত্রেও তাই। বিধায়কদের মধ্যে রয়েছেন বীণা মণ্ডল, নির্মল ঘোষ, শওকত মোল্লা, শ্যামল সাঁতরা, রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস ও গুলশন মল্লিক।

কে কত জনের সুপারিশ করেছিলেন?

সিবিআই-এর নথি অনুযায়ী,

  • দিব্যেন্দু অধিকারী সুপারিশ করেছিলেন ১১ জনের জন্য, যাঁদের মধ্যে ৫ জন চাকরি পেয়েছেন
  • মমতাবালা ঠাকুরের তালিকায় ২০ জন, যাঁদের মধ্যে ২ জন চাকরি পেয়েছেন
  • ভারতী ঘোষের তালিকায় ৪ জন, চাকরি পেয়েছেন ৩ জন
  • শওকত মোল্লার তালিকায় ২ জন, চাকরি পেয়েছেন ১ জন
  • শ্যামল সাঁতরা ২২ জনের জন্য সুপারিশ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ৬ জন চাকরি পেয়েছেন।
  • বীণা মণ্ডলের তালিকায় ১৩ জন, চাকরি পেয়েছেন ৬ জন
  • নির্মল ঘোষের তালিকায় ১৬ জন, চাকরি পেয়েছেন ৬ জন
  • গুলশন মল্লিকের তালিকায় ১০ জন, চাকরি পেয়েছেন ৪ জন
  • রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের তালিকায় ৫ জন, চাকরি পেয়েছেন ১ জন

সুপারিশের অভিযোগ উড়িয়ে দিলেন নেতারা

সিবিআই-এর হাতে থাকা নথি অনুযায়ী, এসব সুপারিশ সরাসরি প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে পাঠানো হয়েছিল। পার্থ বর্তমানে নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় জেলবন্দি। তবে অভিযুক্ত নেতারা কেউই এই অভিযোগ স্বীকার করেননি।

বিজেপি নেতা দিব্যেন্দু অধিকারী ও ভারতী ঘোষ দাবি করেছেন, তাঁরা কোনো চাকরিপ্রার্থীর জন্য সুপারিশ করেননি। একই কথা বলেছেন তৃণমূল সাংসদ মমতাবালা ঠাকুর ও বিধায়ক শওকত মোল্লা। তাঁদের বক্তব্য, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাঁদের নাম জড়ানো হচ্ছে।

প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের তালিকায় চাঞ্চল্যকর তথ্য

সিবিআই-এর দাবি, তারা ১৩৪ জন চাকরিপ্রাপ্ত প্রার্থীর একটি তালিকা প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ থেকেই সংগ্রহ করেছে। ২০২৪ সালের ২৩ আগস্ট তারা পর্ষদের কাছে তথ্য চায় এবং এক মাস পর, ২৩ সেপ্টেম্বর, পর্ষদ এই তালিকা জমা দেয়। এই তালিকায় প্রতিটি চাকরিপ্রার্থীর নাম, রোল নম্বর, বাবার নাম, ঠিকানা, নিয়োগের তারিখ ও সুপারিশপত্রের মেমো নম্বর উল্লেখ রয়েছে।

বিকাশ ভবন থেকে পাওয়া ৩২৪ জনের তালিকা ও পর্ষদ থেকে পাওয়া ১৩৪ জনের তালিকা মিলিয়ে দেখে সিবিআই নিশ্চিত হয়েছে যে সুপারিশকৃত প্রার্থীদের মধ্যে অনেকেই চাকরি পেয়েছেন।

রাজনৈতিক পালাবদলের প্রভাব

২০১৪ সালের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে এই তদন্ত চলছে। তবে যে সময় এই পরীক্ষা হয়েছিল, তখন দিব্যেন্দু অধিকারী ও ভারতী ঘোষ কেউই বিজেপিতে ছিলেন না। দিব্যেন্দু তখন তমলুকের তৃণমূল সাংসদ ছিলেন, পরে ২০২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজেপিতে যোগ দেন। ভারতী ঘোষও তৃণমূল ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন, ২০১৯ সালে তিনি বিজেপিতে যোগ দেন।

তদন্তে মিহির গোস্বামীর নামও উঠে এসেছে, যার পাশে ‘মেম্বার’ (সদস্য) লেখা রয়েছে। তিনি বর্তমানে বিজেপির নাটাবাড়ির বিধায়ক, তবে ২০২১ সালের আগে তৃণমূলে ছিলেন। তদন্তকারীরা খতিয়ে দেখছেন, এই তালিকার মিহির গোস্বামী আদৌ তিনিই কি না।

রাজ্যের রাজনীতিতে নতুন মোড়

প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে এই সুপারিশকাণ্ড এখন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার নজরে। সিবিআই এখনো কাউকে গ্রেফতার করেনি বা কোনো নেতাকে তলব করেনি, তবে তদন্ত এগিয়ে চলেছে। সুপারিশ করা চাকরিপ্রার্থীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এখন সিবিআই যাচাই করছে, তাঁরা সত্যিই যোগ্য ছিলেন, নাকি প্রভাবশালী নেতাদের সুপারিশের জোরেই তাঁরা চাকরি পেয়েছিলেন।

এই কেলেঙ্কারি নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতোরও তুঙ্গে। বিজেপি তৃণমূলকে আক্রমণ করে বলছে, এটি শাসক দলের দুর্নীতির আরও একটি প্রমাণ। অন্যদিকে, তৃণমূলের দাবি, বিজেপিও এই দুর্নীতিতে জড়িত ছিল এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে শুধু তাদের দিকেই অভিযোগের তীর ছোড়া হচ্ছে।

তদন্ত কোন দিকে মোড় নেবে এবং ‘সুপারিশ’ কাণ্ডে কার কী ভূমিকা ছিল, তা সামনে আসতে হয়তো কিছুটা সময় লাগবে। তবে সিবিআইয়ের তদন্তে আসতে পারে বড় কোনো চমক, যা আগামী দিনে রাজ্যের রাজনীতিতে বড়সড় প্রভাব ফেলতে পারে।

মাটির নীচ থেকে গর্জনের শব্দ! ভূমিকম্পের নতুন অভিজ্ঞতায় আতঙ্কিত দিল্লিবাসী— কেন হল এমন?

Read more

Local News