পিলখানার রক্তাক্ত বিদ্রোহে ভারতের যোগ?
বাংলাদেশ সেনার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে ১৬ বছর আগে পিলখানায়। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) সদর দফতরে বিদ্রোহের নামে যে হত্যালীলা চলেছিল, তাতে প্রাণ হারান ৫৭ জন সেনা আধিকারিক-সহ মোট ৭৪ জন। এত দিন পর সেই ঘটনার পুনর্তদন্তে চাঞ্চল্যকর দাবি তুলেছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের গঠিত স্বাধীন তদন্ত কমিশন। তাঁদের বক্তব্য— সেই হত্যাকাণ্ডে ভারতের যোগ ছিল, এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নীরব সম্মতি ছাড়া এমন ঘটনা সম্ভব ছিল না।
১১ মাস ধরে চলা তদন্ত শেষে রবিবার কমিশন রিপোর্ট জমা দেয় ইউনূসের হাতে। অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আলম ফজলুর রহমানের নেতৃত্বাধীন এই কমিশন জানায়, পিলখানার হত্যাকাণ্ড ছিল সুপরিকল্পিত। শুধু বিদ্রোহ নয়, বরং বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার একটি বৃহত্তর কৌশল ছিল এর নেপথ্যে।
কমিশনের দাবি সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছে ভারতের ভূমিকা নিয়ে বক্তব্যে। ফজলুর রহমান বলেন, “ঘটনার সময়ে ৯২১ জন ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ৬৭ জনের কোনো রেকর্ড পাওয়া যায়নি— কীভাবে এলেন, কোথায় ছিলেন, কোথায় গেলেন, কিছুই জানা যাচ্ছে না। এতে স্পষ্ট সন্দেহ তৈরি হয় যে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশকে অস্থির করে তুলতে চেয়েছিল।” তাঁর মতে, সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে (বর্তমানে বিজিবি) দুর্বল করাই সেই পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য হতে পারে।
কমিশন আরও বলেছে, ভারতীয় নাগরিকদের গতিবিধি ও সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে নয়াদিল্লির থেকে আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা চাইতে পারে বাংলাদেশ সরকার। যদিও ইউনূস প্রশাসন সেই পথে এগোবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে— ৬৭ জনের পরিচয় ও ভূমিকা খুঁজে বের করতে হলে ভারতের সহযোগিতা অপরিহার্য।
তদন্তে উঠে এসেছে রাজনৈতিক অস্থিরতার অভিযোগও। কমিশনের দাবি, আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস ছিলেন পুরো ঘটনার প্রধান সমন্বয়ক। তাঁর কার্যকলাপের পেছনে ছিল শেখ হাসিনার সম্মতি— এমনই দাবি তদন্তকারীদের। তাঁদের মতে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ভয়াবহ ব্যর্থতা ছিল হাসিনা সরকারের। পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা সেই রক্তক্ষয়ী ঘটনার মাত্রা আরও বাড়ায়।
পিলখানা ট্র্যাজেডিতে নিহত হয়েছিলেন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ-সহ দেশের বহু অভিজ্ঞ সেনা অফিসার। বিদ্রোহীরা কেবল সৈন্য নেতৃত্বকে টার্গেট করেনি— তাঁদের স্ত্রী ও পরিবারকেও নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়। সেই ভয়াবহ দৃশ্য এখনও বাংলাদেশের ইতিহাসে কালো অধ্যায় হিসেবে লিপিবদ্ধ।
কমিশন বলছে, “এটি কোনো আকস্মিক বিদ্রোহ ছিল না। দীর্ঘ পরিকল্পনার ফসল। উদ্দেশ্য ছিল সেনা কাঠামোকে আঘাত করা।” প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে কিছু সংবাদমাধ্যমের অপেশাদার ভূমিকার কথাও, যাঁরা ঘটনার দিন ভুল ও উত্তেজনাপূর্ণ খবর ছড়িয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে।
এই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসতেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহল তোলপাড় শুরু হয়েছে। ভারতের ভূমিকা নিয়ে এমন সরাসরি অভিযোগ অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দু’দেশের সম্পর্কে এর প্রভাব পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। এখন দেখার, ঢাকা সরকার সত্যিই কি নয়াদিল্লির কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাওয়ার পথে হাঁটে, নাকি এই রিপোর্ট শুধু রাজনৈতিক আলোড়ন হিসেবেই সীমাবদ্ধ থাকে।

